জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

সোমবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১১

শান্তি -অশান্তির গল্প


আজকের দিনটা কাটবে অখণ্ড অবসরে। কোনো কাজ নেই, কম্মো নেই--শুয়ে শুয়ে যত পারো ঘুমোও, নয়তো নৌকোর পাছায় বসে আকাশ পাতাল ভাবো। মাঝি চলে গেছে রাঙামাটির বাজারে, চিকন্যা গেছে, সঙ্গে তার ছেলেদুটোও। চাকমা পাড়ায় আজ পুরুষ নেই বললেই চলে, এমনকী মেয়েদের সংখ্যাও হয়ে গেছে অর্ধেক। খুব বেশি বুড়ো-বুড়িরাই ঘরদোর সামলাচ্ছে যার যার।

আবদুল হক ভাই বুড়ো মানুষ। ৫০ এর কাছাকাছি বয়স। বেচারার কষে ঘুম দেবার ইচ্ছে ছিল। সকালে পান্তা খেয়ে তার ভাবভঙ্গি দেখে উদ্দেশ্যটা ঠিকই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। বিড়ি খেতে খেতে তার হাই তোলার বহর দেখে মনে মনে হাসলাম। মুখে বললাম, ‘আবদুল হক ভাই, গল্প বলো।’

বুড়ো খ্যাঁক করে উঠল। ‘যা ব্যাটা ভাগ!। ঘুম যাইয়ুম।’

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, ঘুমাও। যদি নাকের ছেঁদোয় মরিচের গুঁড়ো নিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস থাকে।’

সে চোখ বড় বড় করে বলল, ‘কী কইলি?’

‘না,’ আড়মোড়া ভাঙলাম আমি। ‘জিজ্ঞেস করলাম আজ কী বার?’

বুড়ো গোমড়া মুখে বলল, ‘সেয়ানা হইছো?’

আমি নিরীহ মুখে বললাম, ‘না।’

আবদুল হক ভাই মত পাল্টাল। ভাবে বোঝা গেল গল্প বলতে আপত্তি নেই। আমি আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলাম। আবদুল হক ভাই হাসল। বলল, ‘গল্প শোনে ছোটরা। তুই ব্যাটা...’

আমি বাধা দিয়ে বললাম, ‘ছোটদের গল্প শোনার শখ নেই আমার। তুমি শান্তিবাহিনীর গল্প বলো।’

সে-সময়টায় আমার মাথায় শুধু শান্তিবাহিনীর কথাই ঘুরত। শান্তিবাহিনী স্বাধীনতা চায়Ñএটা ছিল আমার কাছে একটা চমকের মতো। শান্তিবাহিনী বন্দুকহাতে নৌকো-সাম্পানের মাঝিদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে, একটু উল্টো-সিধে হলেই গালাগাল দেয়, মারেও--এসব ছিল বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। না, তাদের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা আমার ছিল না, শ্রদ্ধা অর্জন করার মতো এমন কিছু গুণপনা তাদের মধ্যে দেখিনিও। তবু আমি শান্তিবাহিনী নিয়ে ভাবতাম। তাদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ দেখাতাম। আর তাদের ব্যাপারে নৌকোর নাইয়া-মাঝিদের মনে ছিল একধরনের চাপা ভীতি ও বিতৃষ্ণা বোধ। তবু প্রথম বার তাদের দেখে যতই ঘৃণা বোধ করি না কেন, ঘৃণার আড়ালে একটা কৌতূহলও জেগেছিল আমার ভেতর।

আবদুল হক ভাই সতর্ক হয়ে গেল। একটু দম ধরে বলল, ‘উঁহুঁ, তার চেয়ে...’

আমি গোঁ ধরলাম। ‘না, শান্তিবাহিনীর গল্পই শুনব। এখানে কেউ নেই। কেউ শুনবে না।’

আবদুল হক ভাই বলল, ‘অত নিশ্চিন্ত হয়ো না। খারাপ খবর বাতাসের আগে ধায়...’

আমি ওসব ধানাই পানাইয়ে গেলাম না। সোজা জিজ্ঞেস করলাম, ‘শান্তিবাহিনী হিলট্রাক্টস স্বাধীন করতে চায় কেন?’

আবদুল হক ভাইয়ের সতর্কতায় ঢিল পড়ল। খেঁকিয়ে উঠে বলল, ‘কচু করতে চায়! স্বাধীনতা ছুইল্যা কেলা, না? কোঁৎ করে গিলে ফেললেই হলো!’

আমি মওকা পেলাম। বুড়োকে একটু চেতিয়ে দিই। খইয়ের মতো ফুটবে তাহলে। বললাম, ‘কচু কেন হবে? বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি?’

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই বুড়ো গর্জে উঠল, ‘বাংলাদেশ! বাঙালির সাথে পাহাড়ীর তুলনা!’

এরকম মন্তব্যের জন্যে তৈরি ছিলাম না। তাই একটু ক্ষূণœ হয়ে বললাম, ‘পাহাড়ীরাও তো মানুষ। এভাবে বলছ কেন?’

আবদুল হক ভাই বলল, ‘শেখ মুজিবও মানুষ। আমিও তো মানুষ। শেখ মুজিব হলো শেষ পর্যন্ত দেশের রাজা আর আমি নৌকোর নাইয়া। আমাদের দু’জনের বয়স তো প্রায় সমান।’

আবদুল হক ভাই নিরক্ষর মানুষ। নিজের নামটা পর্যন্ত লিখতে পারে না। কিন্তু তার কথায় যুক্তি নেই, এটা বলা যাবে না। আমি চুপ করলাম। শান্তিবাহিনী বাঙালিদের দেখাদেখি স্বাধীনতা চাইছে, এটা তো তাদের ভুল, তা একজন নিজের নাম লিখতে না-জানা মানুষও কী সুন্দর করে বুঝতে পারছে। শান্তিবাহিনীর তরুণরা, যারা শিক্ষিতও, তারা কি বুঝতে পারছে না?

বুড়োÑনা, আবদুল হক ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি প্রথম কবে দেখেছ, সেটা বলো।’

আবদুল হক ভাই একটু ক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘তারা স্বাধীন হোক না হোক, তাতে আমাদের কী? আমার কথা হলো, শালারা আমাদের পিটায় কেন? আমরা কি সরকার না গবরমেন্ট?’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘ তুমি পিটুনি খেয়েছ ওদের হতে?’

আবদুল হক ভাই মুখ বিকৃত করল। ‘দু’বার। শালাদের কাছে ময়-মুরব্বির চিন নাই...’

আমার হাসি পেল। দুঃখের ভান করে বললাম, ‘তা তো ঠিক। ঐদিন যাদের দেখলাম, সবার বয়স যদি ওদের মতোই হয়ে থাকে, তাহলে তো তুমি ওদের জেঠার বয়সী হবে।’

বুড়ো আমার ঠাট্টাকে সহানুভূতি হিসেবে ধরে নিল। সায় দিল, ‘হবোই তো। অথচ দেখলি তো সেদিন কী ব্যবহারটাই না করল। যেন ওদের চাকর বাকর...’

আবদুল হক ভাইয়ের মুখ খারাপ। অনর্গল শান্তিবাহিনীর চৌদ্দ গোষ্ঠি উদ্ধার করতে লাগল ননস্টপ ক্যাসেটের মতো। আমি ভয় পেয়ে পংয়ের (ছই) ভেতর থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম কাছে পিঠে কেউ আছে কিনা। নেই। নীরব, নির্জন চাকমা পাড়া।

পংয়ের ভেতর গিয়ে বসলাম আবার। আবদুল হক ভাই বিড়ি ধরিয়েছে। আমাকেও দিল একটা। আমি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললাম, ‘পাঞ্জাবী দেখেছ, আবদুল হক ভাই?’

আবদুল হক ভাই অবজ্ঞার দৃষ্টিতে চাইল আমার দিকে। ভাবখানা যেন, ছেলে বাবাকে জিজ্ঞেস করছে তার দাদার নাম জানে কিনা।

আমি বললাম, ‘শান্তিবাহিনী কি পাঞ্জাবীর চেয়ে খারাপ?’

আবদুল হক ভাই গর গর করতে করতে বলল, ‘পাঞ্জাবী বল, চাকমা বল আর হিন্দু বলÑসব শালাই এক গর্তের শেয়াল। খারাপ লোকদের আবার জাত থাকে নাকি? ওরা সব বেজাত।’

আমি আর কিছু বললাম না। গল্প শোনার শখ মিটে গেছে আমার। বুড়ো এখন খেপে লাল।

পরদিন থেকেই নৌকো বোঝাই শুরু হয়ে গেল। চিকন্যার টিলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন টিলায় ঘুরে ঘুরে ফায়ারউড বোঝাই করছি। চিকন্যা লোকটা খারাপ নয়। আমাদের সঙ্গে সেও আছে। কখনো বৈঠা মারছে, কখনো হাল ধরছে। আবার গাছতোলায়ও হাত লাগাচ্ছে। লোকটা আমুদে, অফুরন্ত কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছে আর হাসছে হা হা করে। গান গাচ্ছে, কখনো চাকমা ভাষায়, কখনো চাটগেঁয়ে আঞ্চলিক ভাষায়। তার সাথে সুর মেলাচ্ছি আমিও। মোটামুটি ভালোই এগিয়ে চলেছে আমাদের নৌকো লোডিংয়ের কাজ।

আধা দিনেই এক নৌকোর চারভাগের এক ভাগ ভর্তি হয়ে গেল। চিকন্যা সাহায্য না করলে অত দ্রুত কাজ এগোত না। সুতরাং আমরা কৃতজ্ঞ তার প্রতি। মাঝির তোয়াজ দেখার মতো। নিজে বিড়ি খায় না, কিন্তু আমাদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে তাকে সেধে বিড়ি খাওয়াচ্ছে। অবশ্য আমরা নিজেরাও চিকন্যাকে খাতির করতে কম যাচ্ছি না।

দুপুরে খাওয়ার পর আবার কাজ শুরু হলো। চিকন্যা এবার আর আমাদের সঙ্গে হাত লাগাল না। ভাতটাত খেয়ে খানিকক্ষণ ঘুমোনোর চেষ্টা করল। কিন্তু আমাদের কাজের হৈ চৈ, গাছের শব্দ--ইত্যাদি গ্যাঞ্জামে খুব একটা সুবিধে করতে পারল না।

আমরা যে-টিলায় মাল ভরছি, তার পাশের টিলায় একটা ক্যায়াং (প্যাগোডা)। মোটামুটি বড়সড়। ক্যায়াংয়ের পেছনে অনেকগুলো ঘর-বাড়ি। এক সময় চিকন্যা ঘুমোনোর আশা বাদ দিয়ে উঠে বসল। হ্ইা তুলতে তুলতে পংয়ের ঘুরানির সাথে ঝুলিয়ে রাখা শার্ট নিয়ে গায়ে চড়াল। মাঝিকে ডেকে বলল, ‘তোরা মাল ভর। আমি ঘুরে আসি।’

মাঝি তাকে ইঙ্গিতে কী একটা প্রশ্ন করল। সে একটু হেসে মাথা দুলিয়ে সায় দিল। তারপর আমাদের বড় নৌকোর সাথে বেঁধে রাখা তার ছোট নৌকোটায় গিয়ে চড়ল। হাসি খুশি লোকটাকে ভালো লেগে গিয়েছিল আমার। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘চিকন্যা দা, কই যাও?’

চিকন্যা নৌকোর দাঁড় বাইতে বাইতে বলল, ‘বিয়ে করতে।’

ওর কথায় মজা পেয়ে কিছু বলতে যাব, তার আগে আবদুল হক ভাই বলে বসল, ‘আ মিলাউয়া গাভুর অবনে, না?’ (মেয়েটা জোয়ান  হবে তো?)

চিকন্যা পাল্টা জবাব দিল। কিন্তু বোঝা গেল না।

তার পরের দিন সন্ধেয় নৌকো পুরোপুরি ভর্তি হয়ে গেল। দু’দিনের টানা পরিশ্রমে শরীরের অবস্থা কাহিল। নৌকোয় ভুসি টুসি মেরে যখন হাত-পা মেলে দিয়ে পংয়ের ওপর বসলাম, তখন রাত ৭টা। আবদুল হক ভাই টিনের চুলোয় ভাত চড়িয়েছে। মাঝি চিকন্যার ঘরে গেছে। আমিও ভাবছি, যাব।  দু’দিন ধরে চিকন্যার ছেলেদুটোর সাথে কথা বলতে পারিনি। পিচ্চি দুটোকে কেন যেন ভালো লেগে গেছে। বিশেষ করে ছোটটাকে। ভাবলাম, আজ ওদের ঘরে বসে ওদের সাথে আড্ডা দেব কিছুক্ষণ। কাল ভোরেই তো নৌকো ভাসাব কাপ্তাইয়ের উদ্দেশে। আবার কখন আসি?

চারদিক নিঝুম সুনসান। রাতের চাকমা পাড়া বড় শান্ত। এ-টিলায় ও-টিলায় দু’একটা বাতি জ্বলছে মিট মিট করে। রাতের আকাশে তারা। এক-আধটু বাতাস আছে কি নেই। পানিতে টিলার ছায়া, আকাশ আর তারারও। পাহাড় থেকে ভেসে আসছে নানা রকম শব্দ, ঝিঁঝিঁর ডাক, পাখির ডানার আওয়াজ। মাঝে মধ্যে কুকুর ঘেউ দিচ্ছে। দু’দিনের একটানা কাজ শেষে এ-বিশ্রামটুকু মনপ্রাণ দিয়ে অনুভব করার মতো। ভাবলাম, আজ রাতে দারুণ ঘুম হবে।

তা হতোই। কিন্তু ওই যে বললাম মাঝি বড় কাবিল, একটু পরে সে নেমে এল চিকন্যার ঘর থেকে। নৌকোর গলুইয়ে উঠেই হাঁক ছাড়ল, ‘আবদুল হক দা!’

হাঁক শুনেই আমার কলজে শুকিয়ে খাক। সম্ভবত আবদুল হক ভাইয়েরও। টিনের চুলায় লাকড়ি ঢোকাতে ঢোকাতে শুকনো স্বরে জবাব দিল, ‘জ্যা।’

মাঝি ততক্ষণে পংয়ের ওপর আমার পাশে এসে গেছে। পা ছড়িয়ে বসতে বসতে বলল, ‘ভাত হয় নাই?’

আবদুল হক ভাই হ্যাঁ-সূচক জবাব দিল। তারপর নিজে থেকে প্রশ্ন করল, ‘নৌকো ছাড়বে নাকি?’

আমি মনে মনে খেপে গেলাম। বুড়োর কিছু দোষ আছে। তার একটা হলো আগ বাড়িয়ে কথা বলা। মাঝি পা চুলকাতে চুলকতে বলল, ‘হ্যাঁ, চলো। ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় কিছুদূর চলে যাই। নয়াবাজার...নয়াবাজার নাহোক, বালুখালী পর্যন্ত গেলেও মন্দ নয়। তারপর শেষ রাতে...’

আমি মাঝির মুখ থেকে কথা কেড়ে নিলাম। রেগে গেছি ভীষণ। দুটো পরিকল্পনা ছিল। রাতে আরাম করে ঘুমোব আর চিকন্যার ছেলেদুটোর সাথে দেখা করব। দুটোই ভেস্তে যাচ্ছে। রাগ চেপে বললাম, ‘শেষ রাতে এখান থেকে গেলে হয় না?’

মাঝি আমার দিকে তাকাল। ভাবলাম খেঁকিয়ে উঠবে। উঠল না। আবদুল হক ভাইকে বলল, ‘কী কও, আবদুল হক দা?’

একটু আশান্বিত হলাম। বোঝা যাচ্ছে, এখনই ছেড়ে যাওয়াটা খুব একটা জরুরি নয়। জরুরি হলে মাঝি ‘গরুকে জিগিয়ে হাল চষতে’ যেত না। আর এভাবে আগ বাড়িয়ে কথা বলে আমিও বিনা ধমকে পার পেতাম না। চিনি তো ওকে।

ভাবলাম, আবদুল হক ভাই আমার সাথে একমত হবে। কিন্তু চুলো থেকে ভাতের হাড়ি নামিয়ে তরকারী চড়াতে চড়াতে বুড়ো বিনয়ে বিগলিত কণ্ঠে জানাল যে, মাঝির ইচ্ছের সঙ্গে তার ইচ্ছের পুরোপুরি মিল আছে। তার সঙ্গে আরেকটু যোগ করে বলল, ‘ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায়...’

মাঝি খুশি হলো। ‘হ্যাঁ, ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায়...’

আমি জুনিয়র নাইয়া, প্রায় নতুন। সুতরাং দ্বিতীয়বার প্রতিবাদ করে ধমক খাওয়ার চেয়ে মুখে কুলুপ এঁটে চুপ থাকাটাই ভালো মেনে নিলাম।

ভাত খেয়ে নৌকো ছাড়লাম। চিকন্যার ছেলেদুটোর জন্য কেন জানি মন খারাপ লাগছে। বড় দুষ্টু পিচ্চিদুটো। মা নেই। সারাদিন নিজের মনে থাকে। আদর করলে হাসে। উল্টোপাল্টা হলে হাতের তাগল (দা) উঁচিয়ে ‘খাক্কে কাবে’, মানে কিনা তক্ষুণি কেটে ফেলে।

আবার আসলে দেখা হবে। কিন্তু আবার কখন আসব? তার ঠিক নেই।

নৌকো এগিয়ে চলল আস্তে আস্তে। আমরা দাঁড় টানছি ঢিমে তেতালে। আবদুল হক ভাই মাথায় গামছা বেঁধে নিয়েছে কুয়াশার ভয়ে। আমার অত ভয় টয় নেই। শরীরের প্রতি অত সোহাগ দেখানো আমার ভাল্লাগে না। তবে আবদুল হক ভাই কিনা বুড়ো মানুষÑ আমি তো আর বুড়ো না।

চারিখ্যঙের মুখ পেরিয়ে কাইঞ্জার মুখে পড়েছি। নৌকো চলেছে পশ্চিম দিকে। আমি গান গাইছি। হরেক রকম। রবীন্দ্র সঙ্গীত থেকে চাটগেঁয়ে আঞ্চলিক পর্যন্ত। মাঝে মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে পশ্চিম দিকে দেখছি। রাঙামাটি শহরের বাতি জ্বলছে অন্ধকারে। রাঙামাটি! আহ, রাঙামাটি!

কাইঞ্জা পেরিয়ে বড়ুয়া পাড়া। তারপর রাঙামাটি ফাড়ির পুবধার ঘেঁষে বালুখালীর দিকে।

ফাঁড়িগুলো পেরোতে ভীষণ বিরক্তি লাগে। শুধু আমার নয়, সবারই। কিছুতেই ফুরাতে চায় না যেন। দাঁড় টানতে টানতে বিরক্তির চরম। মনে হয় অনন্তকাল বাইতে হবে। কোনোদিন আর শেষ হবে না।

ডানে-বামে-সামনে-পেছনে যেদিকেই তাকাও, পানি। পাহাড়গুলো সব দূরে দূরে ভিন্ন জাতির মানুষের মতো। ওপর থেকে আকাশটা যেন উপুড় হয়ে পড়ছে চেপে ধরার জন্যে। আর তার ভয়ে দাঁড়গুলো একঘেঁয়ে স্বরে আর্তনাদ করছে। অথচ পাহাড়-টিলার ফাঁক দিয়ে যে জলপথ, তার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় পথ যেন নিমেষে ফুরিয়ে যায়।

নীরব রাতে শুধু পানির শব্দ আর দাঁড়ের ক্যাঁক্কোরোৎ। আর কোনো শব্দ নেই। আকাশের তারাগুলো অনেক ওপরে, তাদের দিকে তাকানো যায়, কিন্তু তাতে পথের কষ্ট লাঘব হয় না। বরং তাকাতে তাকাতে এক সময় ঘাড় ব্যথা হয়ে যায়।

রাত সম্ভবত নিশীথ। আকাশ, পানি, পাহাড় আর অন্ধকার মিলে অতিপ্রাকৃতিক পরিবেশ। মাঝি বসে আছে পংয়ের ওপর। ঘুমিয়ে পড়েছে না জেগে আছে, কে জানে। জেগে আছে হয়তো, অন্তত নৌকো যখন সোজাই চলছে।

আমার মনে সন্দেহ। যদি শান্তিবাহিনী আসে! বাঙালিদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির অভিযানটা ওরা রাতের বেলাতেই চালায় কিনা, তাই।

নৌকো বাওয়া কষ্টের কাজ হলেও অমন প্রাকৃতিক পরিবেশে শীতের নীরব রাতে এক সময় তাও সয়ে যায়। তাছাড়া যা করতে হয়, তার প্রতি আর বিরক্তি থাকে না শেষ পর্যন্ত। মোটামুটি অভ্যস্ততার ব্যাপারটা এসে যায়। আমার মনে প্রথমত রাতে নৌকো ছাড়ার কারণে বিরক্তি থাকলেও, সময়ের সাথে সাথে অনেক আগে তা মিইয়ে গেছে। মোটামুটি একটা নিষ্পৃহ ভাব নিয়ে দাঁড় টেনে যাচ্ছি, আকাশ-পানি-পাহাড় দেখছি, গান গাচ্ছি, আবদুল হক ভায়ের সাথে ঠাট্টা-মশকরাও চালাচ্ছি মাঝে মধ্যে। কিন্তু আমার ভেতরে শান্তিবাহিনীর সামনে পড়ার যে আতঙ্ক, তার সামান্যতম প্রশমনও ঘটেনি। বিলাইছড়ির খেপ মেরে আসার সময় শা্িন্তবাহিনীর মুখোমুখি হয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা অতো সহজে মুছবে কেন মন থেকে?

কিন্তু ফাঁড়ি পেরোনো যতই একঘেয়ে মনে হোক, নৌকো কিন্তু এক জায়গায় থেমে থাকে না। দাঁড়ের টানে টানে ঠিকই এগিয়ে যায়। বালুখালীর ফোঁড় (এক ফাঁড়ি থেকে আরেক ফাঁড়িতে পড়ার মাঝখানে সামান্য পাহাড়-টিলায় ঘেরা জলপথ) যখন কাছিয়ে এলো, তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক, পথ ফুরাল, আর শান্তিবাহিনীর সামনেও পড়তে হলো না। এবার বালুখালীর ফোঁড়ে নৌকো বেঁধে একটু ঘুমাব। উৎসাহ বেড়ে গেল আমার। এতক্ষণ ঢিলেমি করলেও এবার আবদুল হক ভাইকেও তাড়া লাগালাম, ‘জোরসে টানো মিয়া...’

আবদুল হক ভাইও নড়ে চড়ে উঠল। ‘হুম, মার টান...’

এতক্ষণ বাদে নৌকোর পাছা থেকে মাঝির গলা শোনা গেল, ‘আবদুল হক ভাই।’

আবদুল হক ভাই যথারীতি সাড়া দিল, ‘জ্যা...’

আবদুল হক ভাইয়ের এই ‘জ্যা’ শব্দটা আমার খুব বিরক্তি ধরায়। মনে হয়, একটা রামছাগল, মালিকের গলা শুনে ‘ভ্যা’ করে সাড়া দিচ্ছে। কেন জানি না, কিন্তু আমার মনে হয়। হয়তো মাঝির সব কথায় তার সায় দেবার অভ্যাস বলেই। অন্তত এ পর্যন্ত মাঝির কোনো কথায় ‘না’ বলতে শুনিনি তার মুখে।

আবদুল হক ভাই ‘জ্যা’ বলার পরও খানিকক্ষণ চুপ করে রইল  মাঝি। তারপর বলে উঠল, ‘চলো, নয়াবাজার চলে যাই.....’

আপাদমস্তক জ্বলে উঠল আমার। আবদুল হক ভাইকে চুপি চুপি বললাম, ‘না বলো।’

আবদুল হক ভাই চুপ করে রইল। মাঝি আবার বলল, ‘কী বলো?’

আবদুল হক ভাই হাই তুলল মস্ত করে। তারপর হাই শেষ হওয়ার আগেই হাউ হাউ করে বলল, ‘সেটা তোমার ইচ্ছা।’

সেটা তোমার ইচ্ছা! সাধ করেই কি আর বলি রামছাগল? ধমক একটা লাগাবার ইচ্ছে হচ্ছিল কষেই। কিন্তু জুনিয়র নাইয়া ধমক দিতে পারে না। সুতরাং চুপ থাকতে হলো।

নৌকো বালুখালীর ফোঁড় পেরিয়ে যাচ্ছে। বালুখালীর যেখানে নৌকো ধরার জায়গা, সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কপালে ঘুম নেই।

এবার বালুখালী ফাড়ি। পশ্চিমে বরাদম মিলিটারি ক্যাম্পের অস্পষ্ট আভাস, পুবে পাহাড়শ্রেণী। দক্ষিণে কাপ্তাইয়ের বাতির আলোকচ্ছটায় আকাশ পহর। অগত্যা আবার দাঁড়টানা। তবে যতটা খারাপ লাগার কথা, ততটা লাগছে না। আসলে এমনি হয়। অনিবার্য ব্যাপারগুলো এমনি ঘটে যায়। আমরা তার প্রতিবাদ করতে পারে, নিন্দা করতে পারি মনে মনে; কিন্তু সে জন্যে, যা হওয়ার তা না-হয়ে থাকে না।

মত পাল্টে মাঝির নয়াবাজার চলে যাবার সিদ্ধান্তকে আমি কোনোমতেই সমর্থন করতে পারি না। কিন্তু আমার মতামতের কোনো দাম এখনো মাঝির কাছে হয়নি। সুতরাং প্রতিবাদ করলে ধমক খেয়ে ঘাড় গুঁজে কাজ করতে হতো। অর্থাৎ ইচ্ছেয় হোক আর অনিচ্ছেয় হোক, মাঝির কথা কথা শুনতেই হবে। তাই কাজ করাটা অনিবার্য। অনিবার্য কাজটাকে শিরোধার্য করে নিতেই হয় মাস শেষে বেতনের আশায়। তাহলে শিরোধার্য ব্যাপার নিয়ে আর শির নেড়ে লাভ কী?

দাঁড় টানছি নীরবে। কিছুক্ষণ আগে মাঝি একটু বদান্যতা দেখিয়েছে। আমাকে নাম ধরে ডেকে মিষ্টি-মধুর সুরে গান গাইতে বলেছে। আমি মুখে জবাব দিইনি। মনে মনে বলেছি, তোমার মতো পংয়ের ওপর হাল ধরে বসে থাকলে গান নয়, এতক্ষণে কাওয়ালীর আসর বসিয়ে দিতাম।

কখন যেন চাঁদ উঠেছে। আগে খেয়াল করিনি। চাঁদের আলোয় সব অন্যরকম দেখাচ্ছে। বালুখালী ফাড়ির মৃদু মৃদু ঢেউয়ের ওপর চাঁদের আলো নাচছে। ফাড়ি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আরেকটু পরেই ঢুকব ধানপাতার ফোঁড়ে।

শান্তিবাহিনীর সামনে যখন এতক্ষণ পড়িনি, তখন আর পড়ার আশঙ্কাও নেই। মনের ভার কেটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। নয়াবাজার আর দূরে নেই। যেটুকু পথ, ফোঁড়ের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে চোখের  পলকেই ফুরিযে যাবে। এদিকে পাহাড়ী মোরগের ডাক শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ রাতও শেষ। দেখা যাচ্ছে, সূর্য ওঠার সাথে সাথেই কাপ্তাই জেটিঘাটে পৌঁছা যাবে।

ভালো লাগছে খুব। জেটিঘাটের আজমীর বেকারী ভোরবেলায় দারুণ জমজমাট। গরম গরম পরোটা আর স্যুপ। পরিচিত মানুষদের হাসি-ঠাট্টা। সবই চমৎকার।

ছোট নৌকোটা যেন পাশের টিলা থেকেই নেমে এল পানিতে। তীরবেগে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। আপাদমস্তক কেঁপে উঠল আমার। শান্তিবাহিনী!

মাঝি পংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। আবদুল হক ভাই দাঁড়টানা বন্ধ করে দিয়েছে। আমিও।

নৌকোটা নিঃশব্দে ভিড়ল আমাদের নৌকোর গায়ে। আমরা চুপচাপ। তারা উঠে এল আমাদের নৌকোয়। নিজেদের ওটাকে বাঁধল আমাদেরটার সাথে। ইশারায় দাঁড় দেখাল আমাদের। হাত দিয়ে টানার ভঙ্গি করল। আমরা টানতে শুরু করলাম। তারা দু’জন। একজনের হাতে বন্দুক, আরেকজনের হাতে নয়, কাঁধে বস্তা। সোজা পংয়ের ওপর মাঝির সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

আমি মনে মনে ভাবলাম, খুব ভালো হয়েছে। ফাজিল মাঝি, তোমার শিক্ষাটা যদি এবার পুরা হয়। কী দরকার ছিল বাপু রাত-বিরেতে নৌকো চালানোর? কী ক্ষতি হতো বালুখালী ফোঁড়ে রাতটা কাটালে? এখন খাও বন্দুকের বাড়ি!

আমি কান পেতে দিলাম আগ্রহের সাথে। দেখি ব্যাটা মাঝি কী বলে? কিন্তু দাঁড়ের শব্দে কী শুনব?

আবদুল হক ভাই ফিস ফিস করল। মনে হয় গালি দিল কাউকে। থোঃ করে থুতু ফেলল ডানদিকে। এরপর বাম দিকে। তারপর যেন বাচ্চা ছেলেকে প্রবোধ দিচ্ছে, এভাবে বলল, ‘ভয় নেই। আমাদের কাছে স্লিপ আছে।’

আমি আর ভয় টয় পাচ্ছিলাম না তখন। অবাক হয়ে ভাবছিলাম, বিলাইছড়ির ওদের সঙ্গে এদের এমন পার্থক্য কেন! এরা তো ভারী চুপচাপ!

আবদুল হক ভাইকে বললাম, ‘স্লিপ?’

আবদুল হক ভাই নিচুস্বরে বলল, ‘চুপ।’

দেখলাম, ওরা মাঝির সঙ্গে কথা বলছে। ওরা পংয়ের ওপর বসে আছে, মাঝি দাঁড়িয়ে। তারা কিছু প্রশ্ন করছে, মাঝি জবাব দিচ্ছে। পানির শব্দে আমরা তার কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। একসময় মাঝি তার পকেট থেকে কী যেন বের করে বাড়িয়ে দিল ওদের দিকে। একজন মাঝির হাত থেকে ওটা নিয়ে ভাঁজ খুলল। টর্চ মেরে দেখল কী লেখা আছে। কিছুক্ষণ দেখে টেখে কাগজটা ফিরিয়ে দিল মাঝিকে। নিজেদের মধ্যে কিছু একটা বলাবলি করল। তারপর নিজেদের নৌকোয় নেমে গিয়ে ওটার বাঁধন খুলে দিল।

আস্তে আস্তে আমাদের নৌকো এগাল সামনের দিকে। তারা পিছাতে লাগল। এক সময় চোখের আড়াল হয়ে গেল।

ফোঁড়ের ভেতর দু’দিকের পাহাড়ের ছায়া পড়েছে পানির ওপর। চাঁদ চলে গেছে পাহাড়ের আড়ালে। অন্ধকারে আমাদের নৌকো চলেছে নয়াবাজারের দিকে।

আমি চুপচাপ। আবদুল হক ভাই হঠাৎ গালি দিয়ে উঠল, ‘শুওরের বাচ্চারা!’

আমি ওর দিকে তাকালাম। কেন জানি গালিটা শুনতে ভালো লাগল না। মৃদু স্বরে বললাম, ‘তারা কিন্তু মানুষের বাচ্চার মতো ব্যবহার করেছে। বিলাইছড়ির ওগুলোই ছিল শুওরের বাচ্চা।’

আবদুল হক ভাই আমার আপত্তি দেখেই যেন ‘শুওরের বাচ্চা’ প্রত্যাহার করে নিল। থোঃ করে এক দলা থুতু অন্ধকার পানিতে ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘সব শালাই কুত্তার বাচ্চা। চিনি শালাদের!’

আবদুল হক ভাই প্রায় আমার বাবার বয়সী। গত ত্রিশ বছর ধরে কাপ্তাই হ্রদে নাইয়াগিরি করছে। একদিন আমাকে বলেছিল, কম দেখেনি সে। তার দেখাদেখির মধ্যে অনেক শান্তিবাহিনীও আছে। তবু আমি মজা পেলাম। ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করি, শুওর আর কুত্তার বাচ্চাদের সামনে পড়লে আমাদের কার বাচ্চার  মতো দেখায়? শান্ত, সুবোধ গরুর বাচ্চার মতো, নাকি...? কিন্তু শেষ মুহূর্তে মত পাল্টালাম । শেষরাতে বুড়োকে খেপিয়ে দিয়ে লাভ কী?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন