জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

সোমবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১১

গ্রাম দীর্ঘাপাড়… পোস্টাপিস আমানুল্লা (গল্প)

বাতেন বলল, ‘সব কিছুই আগের মত করার চেষ্টা করা হয়েছে। পুরনো দাগ-নকশা-খতিয়ান ধরে ধরে রাস্তাঘাট, পুকুর আর মক্তব। এই যে এটা হলো বুড়ির পুকুর। ওখানে তো আগে মক্তব ছিল, তাই না? এটা হলো সে মক্তব। আগের মতই পুবমুখী।’
‘নানার কবরটা কোথায় রে? ওনাকে তো শুনেছিলাম বুড়ির পুকুরের পাড়েই কবর দেয়া হয়েছিল...’
‘এই যে, পুকুরের পশ্চিম পাড়ে। এই জায়গাটা...ঠিক এই জায়গাটায় ছিল দাদাজির কবর। কবরস্থানটাও আগের জায়গায় রাখা হয়েছে।’
বুড়ির পুকুরের দক্ষিণ পাড় দিয়েই ছিল ঘাটলাটা। মনে আছে এখনো। তাল গাছের গোড়া ফেলে বানানো হয়েছিল তখন। মানুষ গোসল করত, সকালে আরবি পড়তে এসে ছেলেমেয়েরা মুখ-হাত ধুয়ে অজু করত। শ্যাওলা জমে জমে পিচ্ছিল হয়ে যেত তাল গাছের ঘাটলাটা। অনেকে আছাড় টাছাড়ও খেত শুনেছি।
তালগাছের গোড়ার ঘাটলা এখন আর নেই। এখন পাকা ঘাটলা। বুড়ির পুকুরে মানুষ এখন পাকা ঘাটলায় গোসল করে। পাকা ঘাটলায় গোসল করা এসব মানুষকে আমি চিনি না। কিংবা কাউকে কাউকে চিনি, মানে চিনতাম। কিন্তু যাদের চিনতাম, তাদের মুখ এখন আগের মত নেই। তাদের মুখে এখন পঁচিশ বছরের দীর্ঘ কাল তার অমোঘ হাতের ছাপ বুলিয়েছে। পঁচিশ বছর আগের যুবক মুখ এখন পঞ্চাশ বছরের ছায়ায় আচ্ছন্ন আর কিশোর মুখে কূটিল প্রৌঢ়ত্ব। নোনা বাতাস আর রোদের রসায়নে শরীরী পরিবর্তনের সঙ্গে পার্থিব টানাপড়েনের শৃঙ্খলে বাঁধা মানসিক জটিলতা মিলে পঁচিশ বছরের অদেখার মাঝখানে বিশাল এক দেয়াল তুলে দিয়েছে। সে দেয়ালের ওপার থেকে উঁকি মেরে এরাও কি আমার মুখে খুঁজে পাবে তাদের পঁচিশ বছর আগের স্মৃতি?
‘এই যে রাস্তাটা দেখছেন,’ বাতেন পুবদিকে হাত খেলাল, ‘ওটা মুন্সীরহাটে যাবার রাস্তা। জামাল ব্যাপারী পাড়ার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে আরো উত্তরে, একেবারে মাওলানা ইদ্রিসের মাদ্রাসার সামনে দিয়ে যোগেন্দ্র পুকুরের পাশে বড় রাস্তার সাথে মিলেছে। কাল বের হলে দেখবেন, সব কিছুই আগের মত...’
বাতেন হাসছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। ওর হাসির সৌজন্যে আমারও একটু হাসা উচিত। কিন্তু আমি ভাবছি। বাতেনের চেহারায় পঁচিশ বছর আগের প্রায় শিশুমুখটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। পাচ্ছি না। আমার স্মৃতিতে খোদাই করা ওর সে শিশুমুখে এখন নানারকম জটিল কূটিল ভাঁজ, রেখা। ওর পকেটে মোবাইল বেজে উঠল। মোবাইল বের করে কল রিসিভ করল ও, ‘হ্যা-লো...’
আমি প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে নিজের মোবাইলের অস্তিত্ব অনুভব করলাম। পঁচিশ বছর আগে স্বপ্নেও ভাবিনি, আমার হাতের মুঠোয় এমন একখানা যন্ত্র থাকবে, যা দিয়ে চাইলে সারা পৃথিবীর মানুষের সাথে কথা বলতে পারব।
আধঘণ্টা আগে বড় জেঠাত ভাই ফোন করে বলে দিয়েছেন, কাল সকালে যেন যোগেন্দ্র পুকুরের কোনায় হানিফের দোকানে যাই, ওখানে আমিনের সাথে জমি মাপার ব্যাপারে কথা হবে।
আমি যখন কিশোর, তখনই ভেঙে গেছে বাড়িঘর, জমিন জিরাত। পুবদিকের বিশাল ধানী জমির মাঠের ওপারে দিগন্তের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বসে থাকার সে পুকুর পাড় আমার নেই। পুকুর পাড়ে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক তালগাছগুলোও নেই। আমার স্কুল ভেঙে গেছে, স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে বিকেলে খেলতে যাওয়ার সে-মাঠটাঠও। আমার শিক্ষক, সতীর্থ বন্ধু আর খেলার সাথীরা, যারা এখন হারিয়ে গেছে, তাদের কি আর আগের মত ফিরে পাব? আমি জিজ্ঞাসু চোখদুটো তুলে বাতেনের দিকে চাইলাম। ওর কাছে কি জানতে চাইব? ও এখনো কথা শেষ করেনি। কার সাথে যেন খুব হাসাহাসি করছে।
ও আমার মামাতো ভাই। আমার শৈশব আর কৈশোর কেটেছে নানাবাড়িতে। সুতরাং ওর স্মৃতির সাথে আমার স্মৃতির মিল রয়েছে। ওর সাথে এখন একত্রে বুড়ির পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। ও আমাকে আমার নানার কবর দেখাচ্ছে। ও বলছে সবকিছু আগের মত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাহলে এই বুড়ির পুকুর পাড়ের সামনের মক্তবের ঈদগাহে নানার সাথে ছোটবেলার সে ‘ইয়া নবী সালামালাইকা’ পড়ার দৃশ্যটাও কি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে? আমার নানাও কি আবার ফিরে আসবেন তার সে দীর্র্ঘ দেহ, শ্যামলা মুখ আর গোছা দাড়ির লম্বা চিবুক নিয়ে!
এসব কথা বাতেনকে জিজ্ঞেস করা যায় না। কাউকেই জিজ্ঞেস করা যায় না। এমনকী আমি যে এসব ভাবছি, তাতেও নিজের কাছে নিজেকে অদ্ভূত মনে হচ্ছে।
কিন্তু তবু কেন যে ভাবছি? কেন যে অভিমানে বুকটা দুলে উঠছে? আচ্ছা, নদী কেন ভাঙল? কেন সে আমার ছোট বেলাকে এমন নির্মমভাবে কেড়ে নিল? কেন আমি আমার কৈশোরকে আর খুঁজে পাচ্ছি না পঁচিশ বছর পরে আমার জন্ম-জায়গায় ফিরে এসে? কেন নিজের জন্মভূমিতে নিজেকে আমার অমন বেগানা আর উদ্বাস্তু মনে হচ্ছে? আমার সে মাটি কোথায়, যেখানে আমি প্রথম হাঁটতে গিয়ে ধপাস করে আছাড় খেয়েছিলাম?

পঁচিশ বছর পর জেগে ওঠা চর আবার মানুষের হাতে পড়ে গ্রামের রূপ নিচ্ছে। নকশা মেলে দাগ-খতিয়ান ধরে ধরে মানুষেরা ফের নিজেদের জমি বুঝে নিচ্ছে। নিজের জমি বুঝে নেয়াদের দলে আছি আমিও। শহরের উদ্বাস্তু দৈনন্দিনতার শেকল কেটে পালিয়ে এসেছি শেষ পর্যন্ত নিজের ঠিকানায়। গ্রাম দীর্ঘাপাড়, পোস্টাপিস আমানুল্লাহ...
শহরে আমাদের নিজস্ব গ্রাম নেই, পোস্টাপিস নেই। যা আছে, তা বারোয়ারি। বারো দেশের লোকের ব্যবহারে ব্যবহারে জীর্ণ দীর্ণ। সেখানে এমনকী অনেক সময় এক ছাদের নিচে বছরের পর বছর ঘুমিয়েও একজনের আরেক জনকে চেনা হয়ে ওঠে না। সেখানে সবাই একে অন্যের সঙ্গে সারাদিন কাটিয়ে এসেও রাতের বেলায় বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে কখনো কখনো নিজের গ্রাম-পোস্টাপিসের কথা ভেবে আনমনা হয়ে যায়। একটু ছুটি টুটি পেলেই ছোটে গ্রামে। বাড়িতে নিজেদের পুকুর পাড়ে বসে কদিন নির্ভার অবসর কাটায়। চারদিকে চেয়ে চেয়ে নিজের শৈশব-কৈশোরকে খোঁজে। শীতের উদোম মাঠে ছুটোছুটি, গ্রীষ্মের ছায়াময় আমগাছের তলায় বসে ঝিমোনো কিংবা বর্ষার নতুন পানির বিলে দাপাদাপির স্মৃতিকে খুঁচিয়ে তোলে। তারপর ফের ফেরার প্রত্যাশা বুকে নিয়ে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে শহরের দিকে পা বাড়ায়।
কিন্তু আমার কখনো ফেরার প্রত্যাশা ছিল না। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আমি এখন নিজের গ্রামে। নিজের বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছি। আমিন ডেকে এনে মাপজোক করে শরীকদের কাছ থেকে আলাদা করে নিচ্ছি নিজের জমিজমা। আমার সত্তর বছর বয়েসী বুড়ো বাবা তার পূর্বপুরুষের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া জমি তুলে দিচ্ছেন তার উত্তরপুরুষের হাতে। কিন্তু মাঝের পঁচিশ বছর এই জমি নেই হয়ে গিয়েছিল বিশাল নদীর বুকে। আশ্চর্যের ব্যাপার নয় কি?
আমার বাবার নি®প্রভ চোখে একধরনের তৃপ্তি। আর আমার দু’চোখে যদি কেউ এখন তাকায়, তাহলে সে অবাক হয়ে দেখবে, সেখানে লুকিয়ে আছে এক প্রবল শোক। কারণ এই বিশাল চরে আমি আমার ছেলেবেলাকে খুঁজে পাচ্ছি না।
 সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৯, ২০১১

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন