জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১১

জনকের ছায়া (গল্প)

দক্ষিণের ফিনফিনে বাতাস গা জুড়িয়ে দেয় নিমেষেই। এতক্ষণ ধরে সূর্যের তাপ, গুমোট আর ঘাম মিলে শরীরের জন্যে যে প্রাণান্তকর অবস্থার সৃষ্টি করেছিল, দ্রুত সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটল। সারা শরীর, প্রতিটি লোমের গোড়া স্বস্তির নিশ্বস ফেলে যেন চাঙা হয়ে ওঠে।
গরুদুটোও হাঁসফাঁস করছিল। ভোঁস ভোঁস নিশ্বাসের সাথে নাকের ছেঁদোয় শ্লেষ্মা জমে জমে এক ধরনের ঘ্যাড় ঘ্যাড় শব্দ হচ্ছিল। ভাদ্র মাসের রোদ মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে মাঝে মাঝে গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে, কাদা উঠে উঠে পেট-পিঠ একাকার, মাছি আর ডাঁশের দল মচ্ছব পেয়ে ভন ভন করছে--স্পষ্টতই বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছিল তাদের ঘন ঘন লেজ সঞ্চালনে। দখিনা বাতাসের ফিনফিনে পরশ পেয়ে বোঝা যায়, খুশি হয়েছে তারাও।
ঠিক মাথার ওপর থেকে বিঘতখানেক পুবে হেলে আছে সূর্য। কদম আলীর পেটের ভেতর গুড় গুড় শব্দ ওঠে। পিপাসাও পেয়েছে খুব। ছেলেটা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাপের হাল চষা দেখেছে। ভাঙাচোরা আইল বেঁধেছে জমি থেকে খাবলা মেরে মাটি তুলে। ঘাসটাস বেছে দিয়েছে। সে থাকলে তাকে পানির জন্যে পাঠানো যেত। কিন্তু রোদের তেজ দেখে কদম আলী নিজেই তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে বিল থেকে।
ধারে কাছে বাড়ি-ঘর নেই। বিস্তীর্ণ বিলের মাঝে সে একা। চারপাশে রোপা আরোপা ধানের জমি। এমন প্রায় হয় না। এখন রোপার মৌসুমে নির্জন বিলের কথা ভাবা যায় না। তবু আজ সে একা। বিলের দক্ষিণ ও উত্তর-পশ্চিমাংশে যারা আছে, তাদের সঙ্গী হিসেবে নেয়া যায় না। এখান থেকে ডেকে গলা ফাটালেও সে-ডাক তাদের কানে পৌঁছবে না। সুতরাং তাদের কাছে পানি থাকতে পারে, এ আশা করা গেলেও আশা পূরণের অবকাশ নেই এবং যদিও পানির ঠাণ্ডা, তরল স্বাদের কথা ভেবে কদম আলীর শুকনো কণ্ঠ-তালু চনমন করে উঠছে, তবু আপাতত ধৈর্যসহকারে কারবালা ময়দানের নজির টেনে মনকে বোঝানো ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
এ-মুহূর্তে হাতেম আলী তরফদারের সুরেলা পুঁথির টান তার মনের ভেতর গুঞ্জন তুলতে চায়। তার গলা ভাল নয়, শ্লেষ্মাজড়ানো ফ্যাঁশফ্যাশে। তবু এ-রোদ্দুরে পিপাসায় ক্লান্ত শুকনো গলায় সুর তুলতে যায় সে। কিন্তু রাত জেগে ‘জঙ্গে কারবালা’ শুনলেও ছাড়া ছাড়া দু’একটা লাইনই কেবল তার মনে থাকে। এ-মুহূর্তে তাই গলা ছাড়তে গিয়ে কেবল ‘পানির পিয়াসে মর্দের ছাতি ফেটে যায়’-এই লাইনটিই মনে আসে। তবে তাতে খুব একটা অসুবিধে হয় না। দখিনা বাতাসের হালকা পরশ তার শরীরের মত বুকের ভেতরটাও হালকা করে দেয়। গলায় শ্লেষ্মা নিয়েই তাই সে লাইনটাকে বারবার কাজে লাগায়।
কিন্তু শীঘ্রই তার গলায় ভাটা পড়ে। হঠাৎ আসা পলকা বাতাস হঠাৎ চলে যায়, সে টেরও পায় না। গনগনে রোদ তাকে সেদ্ধ করতে থাকে অনবরত। তার  মনে হয়, মাথার তালু গরম হয়ে ভেতরের মগজ টগজ সব গলে গলে নেমে আসছে চুল, কানের গোড়া, কপাল আর চোখের কোণ বেয়ে। পাকানো কালো হাতের চামড়া, তালু ভিজে চটচটে, ময়লা; পাতলা লোম খাড়া হয়ে আছে পোড়ামাটিতে গজানো শ্রীহীন, উস্কখুস্ক  ঘাসের মত।
ডাঙায় তোলা মাছের মত দমের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকে সে। মেঘভাঙা রোদ বাঘের মত লাফিয়ে পড়ে তার ঘাড় মটকে দেয়। সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং এক সময় ফোরাত নদীর পাড়ে কারবালা প্রান্তরে তাঁবুর ভেতর বন্দী শিশু আসগরের পিপাসায় ককিয়ে ওঠা কান্নার মতই মনে হয় তার নিজের গলার স্বরকে।
 সে কিছুক্ষণ চুপচাপ ধুঁকতে থাকে। গরুদুটোর লেজ মুচড়ে দেয় ‘হেট হেট’ বলে। জিভ আর তালুর সংঘাতে শব্দ সৃষ্টি করে উৎসাহ দেয়। ডাঁশ আর মাছির অবিরত জ্বালাতনের প্রতিবাদে লেজ নাড়ানোয় ব্যস্ত গরুদুটো ভোঁস করে সাড়া দেয় তাতে। হাঁটুপানি আর কাদা ভেঙে হাঁটার গতি বাড়নোর চেষ্টা করে।
কদম আলীর পেটের ভেতর  আবার গুড় গুড় শব্দ ওঠে। কিন্তু তাতে মনেযোগ দিতে চায় না সে। তবে পিপাসার ব্যাপারে মনেযোগ দিতে তার আপত্তি থাকে না। সে ঢোক গিলে বারবার গলা ভেজাতে চায়। প্রথম সুযোগেই লম্বা একটা দম নিয়ে এক জগ ঠাণ্ডা, অতি ঠাণ্ডা পানি গলাধঃকরণ করার কথা ভেবে লোভাতুর হয়ে ওঠে। কিন্তু সে শীঘ্রই ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং তার পিপাসা ক্রমে তীব্রতা লাভ করে। সুতরাং সে অন্যমনস্ক হয়ে পিপাসা ভোলার জন্য আবার গান গাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। কিন্তু কোনো গানই তার পুরোপুরি মুখস্থ নয়। তবে অনেক রকম গানের ছুটকা ছাটকা লাইন মনে আছে। সে কিছু লাইন মনে মনে আওড়ায়, কিন্তু মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে না একটাও। শেষে বোধ হয় একটা লাইন তার ভরী মনে ধরে যায়। সে কিছুক্ষণ লাইনটি নিয়ে নাকে গুন গুন করে। এক সময় গলায়ও ধরে বসে। এই পিঠফাটা ভাদ্রের রোদ্দুরে গানের লাইনটা খাপে খাপে মিলে যায়। এরকম যুৎসই একটা গান মনে করতে পেরে নিজের ওপর ভারী খুশি হয়ে ওঠে সে। তার খুশির ভাগ সে গরুদুটোকেও দেয়। জিভ আর তালুয় শব্দ সৃষ্টি করে লেজ মুচড়ে দেয় ‘হেট হেট’ বলে। তারপর গলা ঝেড়ে শ্লেষ্মা সরিয়ে আবার গেয়ে ওঠে: আল্লা, মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে তুই...
কিন্তু ভাদ্র মাসের মেঘ ত্যাঁদড় কম নয়। আকাশের এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে জটলা পাকালেও কদম আলীর ডাকে সাড়া দিয়ে ছায়া দিতে এগিয়ে আসে না। আর সূর্যটাও যেন আল্লাহর সাথে কদম আলীর ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে দ্বিগুণ রাগে জ্বলতে থাকে।  গান গাইতে গাইতে কদম আলী দূরে, দক্ষিণে সরকারদের জমিতে কামলাদের ধান রোপা দেখে। মনে মনে হিসেব করে, কম পক্ষে বিশ-বাইশ জন  লোক নেমেছে ধান রোপায়। মানুষগুলো রুকুর ভঙ্গিতে পশ্চিমে ঝুঁকে পুব দিকে পিছু হটে যাচ্ছে। এতদূর থেকেও সে তাদের হাতের দ্রুত ওঠা নামা আঁচ করতে পারে। মানুষগুলো বোঝা যায়, বেশ ফুর্তিতে আছে। এমন মাঠজ্বলা রোদের ভেতরেও গান গাইছে তারা। গানের কথাগুলো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু সুরটা ঠিকই ধরা যায়। পাইন্যা সাইর।
পাইন্যা সাইর গাইতে তারও খুব ভাল লাগে। কিন্তু মুশকিল হলো, কোনো গানই তার পুরোপুরি মনে থাকে না। পাইন্যা সাইরের আল্লা-রছুল, মা ফাতেমা, হজরত আলী, পাঁচ পীর আর পাঁচ কলেমা--এই কয়টি কথাই এখন তার এলোমেলোভাবে মনে পড়ছে। কিন্তু এভাবে এলোমেলো শব্দ গেঁথে গান গাওয়া যায় না। নইলে সেও আরম্ভ করত এখন। হোক সে একা। তাতে কী? একা একা গান গাওয়ারও আলাদা একটা মজা আছে। অন্তত কিছুক্ষণ তো সব কিছু ভুলে উদাস হয়ে থাকা যায়। কদম আলী হঠাৎ আবিষ্কার করে, এতক্ষণ সে ‘আল্লা মেঘ দে, পানি দে’ গেয়ে পিপাসা ভুলেছিল।
 সে এখন আর আগের মত তীব্রভাবে পিপাসা বোধ করছে না। দূর  হতে ভেসে আসা ‘পাইন্যা সাইর’এর করুণ সুর তার ভেতরে এক ধরনের উদাসীনতা সৃষ্টি করেছে। ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে সারা মাঠ ঝলসে যাচ্ছে। রোপা আমন ধানের কচি চারাগুলো ঘোলা পানির ওপর হলুদ পাতা জাগিয়ে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের কিনারায় ধূসর কালো মেঘ থমকে আছে নির্লিপ্তের মত। দু’একটা চিল মাঝে মাঝে মাথার ওপর তীক্ষ্ম করুণ সুরে ডেকে উঠছে। চারদিকের সমস্ত নৈঃশব্দ্য চিরে চিরে যাচ্ছে তাতে আর কানের ভেতর ঝিম ঝিম করে উঠছে। কদম আলী নিজেকে হঠাৎ খুব একাকী অনুভব করে। দক্ষিণ দিক হতে ভেসে আসা ‘পাইন্যা সাইর’এর অস্পষ্ট সুর যেন ঝাঁঝাঁলো দুপুরের সমূহ তীব্রতায় চারদিক থেকে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সে অন্যমনস্কভাবে, অনেকটা অভ্যাসের বশেই গরুদুটোর লেজ মুচড়ে দেয়। জিভ আর তালুয় শব্দ সৃষ্টি করে না, পাছে তার অখণ্ড মনোযোগে ফাটল ধরে।
‘বুইজলি কদম, গান বড় ভালা জিনিস রে। গান হুইনলে মন ছাফ থাকে, শরীর ভালা থাকে। যেঁইক্তে তুই গান হুইনবি, গানের মতন গান অইলে হেঁইক্তে তোর মনে কন’ দুক্ক থাইকত ন’।’
বাজান গল্প করত কদম আলীর সাথে। বাজানের কথা মনে হতেই তার মন গলে যায় বাজান খুব ভাল গান গাইত। সেই কৈশোরে সে যখন বাজানের সাথে মাঠে যেত, তখন বুঝতে পারত, মাঠের আর সকলের গলার ওপরেই তার বাজানের গলা। গানের সুরে বাজানের মাথা দুলত আর বাতাসে উড়ত তার বাবরী চুলের গোছা। কদম আলী আইলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকত আর মন দিয়ে তার বাজানের গান শুনত। বাজানকে তার অন্য রকম মনে হতো তখন। বাজান যেন রাজা আর কামলারা, যারা বাজানের গানের দোহার টানত, তারা সব প্রজা। অথবা বাজান ওস্তাদ, আর তারা সব সাগরেদ। কদম আলীর বুক গর্বে ভরে উঠত। তার বাজানের মত গান কেউ গাইতে পারে না। তার খুব ইচ্ছে হতো, বড় হলে সেও বাজানের মত বিরাট গায়েন হবে।
 সেসব কত কাল আগের কথা। অথচ মনে হয়, মাত্র সেদিন। এখনো চোখের সামনে জ্বল জ্বল করছে সন্ধের সময় ঘরে ফেরা বাজানের রোদে পোড়া ক্লান্ত অথচ শান্ত মুখ। বাজান সবাইকে নিয়ে এক সাথে রাতের ভাত খেত। তারপর মার হাতে সাজিয়ে দেয়া হুঁকোয় চোখ বুজে গুড়–ক গুড়–ক করে তামাক টানত। তার চারদিকে ধোঁয়ার মেঘ ভেসে বেড়াত আর তামাকের কটু গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠত। মা সুপুরি কেটে পান বানাত। চিকন ফালির খিলি পান। তারপর পিতলের পানদানীর চারদিকে সাজিয়ে দিত। এক সাথে দশ-বারো খিলি। খুব পান খেত বাজান।
বাজান মাঠে গান গাইত, মাঝে মাঝে রাত্রে ঘরের আঙিনায় পাটি বিছিয়ে গানের আসর বসাত। শীতের প্রথমে মাঠ থেকে আমন ধান কাটার পালা শেষ করে সবাই যখন হাত-পা ঝেড়ে একটু সুস্থির হয়েছে, তখনই শুরু হতো গানের আসর। পাড়ার হাশেম চাচা, বনির বাপ জেঠা, গওহর আলী, লতু মামা--সবাই আসত সে আসরে। তাদের চারপাশে গোল হয়ে বসত, যারা গান শুনতে আসত তারা। গান গাইত বাজান, মাঝে মাঝে অন্যেরা মিলে দোহার টানত। আস্তে আস্তে রাত বাড়ত। শীতের চাঁদ ফুটফুটে আলো ছড়াতে ছড়াতে এক সময় পশ্চিমে হেলে পড়ত। তখ ভাঙত আসর। কদম আলী বাজনের গান শুনত। শুনতে শুনতে এক সময় ঢুলতে শুরু করত। তারপর ঘুমিয়ে পড়ত বাজানের কোল ঘেঁষে। অনেক রাতে আসর ভাঙলে বাজান তাকে কোলে করে ঘরে নিয়ে নিজের পাশে শোয়াত। সে সময় আধ ঘুমে আধ জাগরণে তার কানে বাজত বাজানের গাওয়া গানের কলি: খাঁচার ভিতর  অচিন পাখি কমনে আসে যায়...
আসলে বাজান বড় গানপাগলা ছিল। গান ছাড়া অন্য কিছু খুব কমই বুঝত। গানই ছিল তার আনন্দ, তার সুখ। কদম আলী নিজেকে তাই খুব দুঃখী ভাবে। সে গায়েন  বাপের ছেলে। ছোটবেলায় বাজানের মত গায়েন হওয়ার তারও খুব ইচ্ছে ছিল--কিন্তু শেষ পর্যন্ত গান তার দ্বারা হয়নি। তার গলা ভাল নয়, ফ্যাঁসফেঁসে; তা ছাড়া কোনো গানই দু’এক লাইনের বেশি সে মনে রাখতে পারে না। সে জন্যে বুঝি তার রাগও ধরে নিজের ওপর। কিন্তু কিছুই করার নেই। গলা তো কেউ নিজে বানাতে পারে না, খোদায় না দিলে। তবে গান গাইতে না পারলেও  শোনার অভ্যাস সে বাজানের কাছে ঠিকই পেয়েছে। গান শুনেই সে গাইতে না-পারার দুঃখ ভোলে।
কদম আলী এসব ভাবতে ভাবতে খুব আনমনা হয়ে যায়। বাতাসহীন দুপুর প্রকৃতির অসহ্য গুমোট আর তপ্ত রোদ তার মাথার তালু ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যায়। তারপর লোমকূপের গোড়া বেয়ে বিগলিত ঘামের অবিরাম ধারায় দর দর বেগে নেমে আসে নিচের দিকে। ঘাড় থেকে, কপাল থেকে বুকে-পিঠে, বুক-পিঠ বেয়ে কোমরের দিকে। বাজানের কথা ভেবে তার মন কাদা কাদা হয়ে যায়। হঠাৎ তার খেয়াল হয়. বহুদিন ধরে সে বাজান আর মার কবর জেয়ারত করেনি।
 জেয়ারত করতে গেলে খরচাপাতি আছে, মোল্লা-মৌলভীদের পয়সা দিতে হয়। সে নিজে জেয়ারতের নিয়ম টিয়ম জানে না। জেয়ারত করতে গেলে আরবিতে দোয়া-দরুদ পড়তে হয়। আল্লার খাছ রহমতের ভাষা আরবি, সে মোল্লা-মৌলভীদের ওয়াজ করতে শুনেছে। বাঙলায় নাকি জেয়ারত হয় না। এ জন্য কদম আলী এখন খুব দুঃখবোধে আক্রান্ত হয়। অনুতাপে তার বুক ভেঙে যেতে চায়। ছোটবেলায় বাজান তাকে মক্তবে দিয়েছিল। কিন্তু মক্তবে পড়ার চেয়ে মক্তব থেকে পালানোতেই কদম আলীর ঝোঁক ছিল বেশি। শেষে বাজান তাকে বাড়িতে বসিয়ে ছুরা-কেরাত শিখিয়েছিল কিছু। কোনোমতে নামাজ পড়ার উপযোগী করে। তবে সেসব পুরোপুরি মুখস্থ আছে কিনা কদম আলী এখন আর তা হলফ করে বলতে পারবে না।
নামাজ সে পড়ে না। অথচ জানে, মোছলমানের ফরজন্দ সে, নামাজ তাকে পড়তেই হবে। আজ হোক, কাল হোক কিংবা হোক দু’দিন পরে। নইলে হাশরের দিন আল্লাহর পাওয়ার কোনো আশা নেই। দোজখের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরতে হবে অনন্তকাল। অনন্তকাল বলতে ঠিক কতটা সময়, বুঝতে পারে না কদম আলী। তবে তা যে খুব কম সময় নয়, তাতে তার কোনো সন্দেহ নেই। হয়তো তা লাখ লাখ কোটি কোটি  বছর কিংবা তার চেয়ে আরো অনেক বেশি। একমাত্র আল্লাহ্ই তার সঠিক হিসেব জানে। কিন্তু সে মাঝে মাঝে খুব আশ্চর্য বোধ করে। একটা মানুষের বয়সের সীমার তুলনায় লাখ-কোটি বছর তো বিরাট ব্যাপার। তাহলে মানুষের বয়স এত কম হয় কেন? আর এই সামান্য, বলতে গেলে সাগরের বুকে এক ফোঁটা পানির সমান সময়ের জন্য দুনিয়াতে আসাই বা কেন? এবং এ সামান্য সময়ে জীবনের ভাল-মন্দের বিচারে অনন্ত কালের বেহেস্ত কিংবা দোজখ, তাও বা কেমন? শেষমেষ তালগোল পাকিয়ে ফেলে সে।        
এরকম মারফতি কাজকারবার নিয়ে সে অনেকদিন ভেবে টেবে দেখেছে। মন দিয়ে হাতেম আলী তরফদারের পুঁথি শুনেছে, বিস্তর শরীয়তী-মারফতি গানটানও শুনেছে। কিন্তু সবকিছুই তবু তার কাছে বিরাট রহস্য। তবে এসব কিছুকে ভুলে থাকা কিংবা অবিশ্বাসের হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়ার শক্তিও তার নেই। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কোনো অলস মুহূর্তে এসব ভেবে রীতিমত বিচলিত বোধ করে। তার ভেতর থেকে কে যেন তাকে হঠাৎ হঠাৎ সাবধান করে দেয়। সে শুধু একধরনের অপরাধবোধে জর্জরিত হতে থাকে।
অপরাধবোধ তার এখনো কাটে না। সে মূর্খ, এটাই তার নিজের কাছে নিজের অপরাধ বলে মনে হয়। দুনিয়া আর আখেরাতের যেসব জটিল তত্ত্ব নিয়ে সে মাথা ঘামাচ্ছে, সেসব নিশ্চয় অসম্ভব প্রশ্ন নয়। এরও জবাব হয়তো কোথাও আছে। কিন্তু সে জবাব একমাত্র তার মূর্খতার জন্যই তার কাছে অস্পষ্ট। কেউ তাকে সেসব বুঝিয়েও দিতে পারে না। কারণ মূর্খতা শুধু তার মধ্যেই নয় নয়, তার আশেপাশে যাদের সাথে তার ওঠা-বসা, তাদের সবার মধ্যেই। তারাও কি কদম আলীর মত এসব জটিল ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায়?
‘বাজান।’
কদম আলী ভীষণ চমকে ওঠে। ‘কে?’
‘আঁই, বাজান। আমনের লাই পানি আইনছি।’
‘পানি আইনছছ?’
দর দর করে ঘাম ঝরছে কদম আলীর শরীর থেকে। কপালের শিরা লাফাচ্ছে তিড়বিড়িয়ে। কান ঝিম ঝিম করছে। এতক্ষণ সে সবকিছু ভুলেছিল। ভাদ্র মাসের টগবগে রোদ, ঝাঁ ঝাঁ আকাশ, চারপাশের হলুদ বিশীর্ণ রোয়ার জমিÑএমন কী, দূর থেকে ভেসে আসা ‘পাইন্যা সাইর’এর মন কেমন করা সুর পর্যন্ত। তার সামনের লাঙলটানা জলজ্যান্ত গরুদুটোর অস্তিত্বও। হঠাৎ ভীষণ ক্লান্তি বোধ করে সে। ছেলের হাতের পানির জগ তার সমস্ত ধৈর্যের  বাঁধ ভেঙে চুরমার করে দিয়ে তাকে টান দেয় সবলে। লাঙল থামিয়ে কোমর থেকে গামছা খুলে নিয়ে হাত, মুখ আর কপাল মুছতে মুছতে আইলের দিকে হেঁটে আসে সে পানিতে থপ থপ করে।
 ছেলে হাত থেকে পানির জগ নিয়ে ঢক ঢক করে পানি খেতে থাকে সে। এক টানে জগের পানি অর্ধেকে চলে আসে। একটু দম নেবার জন্য জগ হতে  মুখ সরিয়ে থামে সে। বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে ঠোঁট কাছায় জমে ওঠা পানি আর ঘাম মোছে।
‘মা আমনের লাই বুলি পিডা পাডাইছে, বাজান।’ কদম আলীর ছেলে কোঁচর  খুলে আটার রুটি বের করে। কদম আলী খুব খুশি হয়ে ওঠে। দুটো রুটি খেলে পেটের খিদে কিছুটা কমবে। আরো ঘণ্টাখানেকের কাজ বাকি আছে মাঠে। হাত বাড়িয়ে ছেলের হাত থেকে রুটিদুটো নিয়ে এক কামড়ে একটা রুটির আধখানা ছিঁড়ে চিবোতে থাকে সে। ঠাণ্ডা, বাসী আটার রুটি। চিবোতে গেলে জিভ, তালু আর দাঁতের গোড়ায় ভ্যাচ ভ্যাচ শব্দ হয়। কদম আলী আরেক ঢোক পানি খেয়ে নেয়।
কদম আলীর ছেলে থামিয়ে রাখা লাঙলের দিকে এগিয়ে যায়। বলে, ‘আমনে জিরান, বাজান। আঁই আস্তে আস্তে চয়ি।’
কদম আলীর মন ছেলের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। এতটুকু ছেলে, তবু দেখো, বাজানকে কেমন জিরোতে বলছে! বাজানের কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছে। ভারী স্নেহে তার বুক ভরে ওঠে। সাথে সাথে কেমন একটা চিনচিনে ব্যথাও জাগে ভেতরে। আবার তার বাজানের কথা মনে ওঠে। খুব ছোট বয়সে জমিনের আইলে দাঁড়িয়ে বাজানের গান শুনতে ভাল লাগলেও একটু বড় হয়ে যখন কাজ-কর্ম করার মত হয়েছে, তখন তাকে আর মাঠে খুঁজে পাওয়া যেত না। বাজান এ নিয়ে সময় সময় রাগ করত। কোনো কোনো সময় বোঝাতÑ--কিন্তু কদম আলীর কী যে হয়েছিল! কাজেকর্মে একদম মন দিত না। বুড়ো বাপকে সাহায্য করার চাইতে এখানে ওখানে আড্ডাবাজি করতেই তার ভাল লাগত বেশি। অবশ্য একদম যে কাজ করত না, তা নয়। তবে তা যে নেহাৎ বাজানের রাগ বা চেঁচামেচির চাপে পড়ে, বুড়ো বাপের প্রতি মমতাবশে নয়, বাজান তা বুঝতে পারত। কিন্তু কদম আলীর তাতে কিছু আসত যেত না। ফাঁক পেলেই আবার সে লাপাত্তা হয়ে যেত।
আসলে কিছু কিছু জিনিস মানুষকে নিজের জীবন থেকে শিখতে হয়, কিছু জিনিস কেউ কাউকে বলে বোঝাতে পারে না। নিজের ছেলের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করতে গিয়ে এ মুহূর্তে কদম আলী অতি সহজে এ সত্যটা বুঝতে পারে। বাজান বুঝি ছেলের কাছে কাজের চেয়ে বাপের প্রতি তার মমত্ববোধটুকুই প্রত্যাশা করত বেশি। কিন্তু মানুষের কিছু কিছু শিক্ষা তখনই হয়, যখন তা আর কোনো কাজে লাগে না।
রুটি চিবোতে চিবোতে কদম আলী দূরে দিগন্তের দিকে তাকায়। ঘোলাটে মেঘে ম্লান দিগন্ত রেখাও যেন তার দিকে চেয়ে থাকে ঝাপসা দৃষ্টি মেলে। হঠাৎ তার চোখ কেমন জ্বালা করে  ওঠে। আহা, বাজান! বাজান গো...
‘পাইন্যা সাইর’এর সুর ভেসে আসছে অবিরাম। হাল চষতে চষতে কদম আলীর ছেলে  গান শোনে। কদম আরী জগের বাকি পানিটুকু শেষ করে ট্যাঁক হতে চীনে কাগজে মোড়ানো বিড়ির প্যাকেট বের করে বিড়ি ধরায়। লম্বা এক টানে একগাল ধোঁয়া গিলে কাশতে কাশতে বলে, ‘আস্তে আস্তে চয়িছ, বাজান। চাইছ, গরু ফাল খাইব।’
কদম আলীর ছেলে কদম আলীকে অভয় দেয়, ‘খাইত ন’, বাজান।’
এরপর সে দক্ষিণ দিকে গান গাওয়া লোকগুলোর দিকে আঙুল উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, পাইন্যা সাইর, না বাজান?’
কদম আলী হাসে। ‘হ্যাঁ।’
হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসা সুরের সাথে কদম আলীর ছেলেও তার রিনরিনে গলা মিলিয়ে দেয়:
ও রে মোহাম্মদ মোহাম্মদ মানি রে জোয়ান
জোয়ান রে, মোহাম্মদ মোস্তফা
ও রে যে জনা মোহাম্মদ মানে রে
মিলে যায় তার খোদা...হায় রে
কদম আলী চমকে ওঠে। ছেলের দিকে অবাক চোখে তাকায়। বাপের সামনে গান গাইতে লজ্জা পাওয়ার মত বোধ-বুদ্ধি তার হয়নি এখনো। ছেলেকে সে গুন গুন করতে কিংবা কখনো গলা ছেড়ে গাইতেও শুনেছে। কিন্তু তাতে অবাক হওয়ার মত কিছু আছে বলে মনে হয়নি। অথচ এখন তাকে গান গাইতে শুনে তার ভেতরে কেমন একটা আলোড়ন জাগে। তার হাতের বিড়ি নিভে আসে। এক মনে ছেলের গান শোনে সে।
জোয়ান রে, আল্লা সে অসীম
আল্লা না চিনিলে রে মনা
কেমনে পাইবা মোহাম্মদের দীন রে...
মরি হায় হায় রে
...একটা ছায়া বড় হচ্ছে কদম আলীর সামনে। ছায়া নয়, অবয়ব। ছোট্ট একটা অবয়ব ক্রমান্বয়ে দীর্ঘ হচ্ছে। একটা মানুষের অবয়ব। তার মুখে পাতলা ফিনফিনে দাড়ি, মাথায় লম্বা চুল, তেলচোপানো বাবরী ছাটা। সে চুল উড়ছে বাতাসে, আর বাবরী চুলের মালিক সে মাথাটা এদিক ওদিক দুলছে। ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে। আর কদম আলী সেদিকে তাকিয়ে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে হতে শেষ পর্যন্ত যেন একটা বিন্দুতে পর্যবসিত হচ্ছে।
‘বাজান।’
সংবিত ফিরে পায় কদম আলী। ছেলের দিকে তাকায়। গরম, ঘাম আর হালচষার পরিশ্রমে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে ছেলেটাকে। তাড়াতাড়ি আইল থেকে জমিনে  নামে সে। পানির জগ নিয়ে কদম আলীর ছেলে আঁকাবাঁকা আইল বেয়ে চলে যেতে থাকে। কদম আলী সেদিকে, ছেলের চলার পথে বারবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। অদ্ভুত একটা সুখে তার বুকের ভেতর তোলপাড় জাগে। হঠাৎ সে ভাদ্র মাসের মেঘভাঙা রোদেভরা ঝাঁঝাঁল আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায়। একটা মেঘ ভাসতে ভাসতে চলেছে সূর্যের দিকে। এক্ষুনি তার ছায়া এসে পড়বে পৃথিবীতে। কদম আলী হঠাৎ বিড়বিড় করে ওঠে, ‘বাজান, তুমি তো এখন বেহেস্তের বাগানে বয়ি রইছ। চাইয়া দেখ বাজান, তোঁয়ার নাতির দিকে চাইয়া দেখো। তুমি তারে এই মেঘের মতন ছায়া দিও। জানো, তোঁয়ার নাতি তার বাপের মতন অয় ন’। তার দাদার মতনই অইছে। হে তোঁয়ার মতন গান গায়, বাজান। তোঁয়ার মতন পাইন্যা সাইর গায়। তুমি তারে দোয়া কইর। আর আমারে..আমারে..’
কদম আলীর চোখ ক্রমে ঝাপসা হয়ে আসে। চোখের কোণ বেয়ে ঘামের ধারার মত ধারা নামে। সে তাড়াতাড়ি মুখ নিচু করে হাতের  উল্টো পিঠে চোখের কোণ মোছে। তারপর গরুদুটোর লেজ মুচড়ে দেয় সজোরে--এই হেট হেট! গরু হেট হেট...
 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন