জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

সোমবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১১

স্বর্ণদ্বীপের ছেলে (কিশোর গল্প)

স্বর্ণদ্বীপের ছেলে (কিশোর গল্প)

একটা ছোট্ট ছেলের গল্প এটা। বারো কি তেরো বয়েস। তার সাথে দেখা  হলেই সে এক আশ্চর্য স্বর্ণদ্বীপের গল্প শোনাবে।
ভেবো না সে কোনো রাজার কুমার কিংবা মন্ত্রিপুত্র, অথবা কোটালের ছেলে। সাত সমুদ্র তেরো নদী জুড়ে ময়ুরপক্সক্ষী নৌকোয় ভেসে বাণিজ্য করে বেড়ানো নামজাদা কোনো সওদাগরতনয়ও নয় সে। আসলে সে খুব সাধারণ একজন মানুষের ছেলে।
বাবা দিনভর মাঠে কাজ করত, রাতভর বেঘোরে ঘুমোত। মা মাটি গুলে ঘর-দোর নিকোত, উঠোনে ধান শুকোত আর ফাঁকে ফাঁকে লাউয়ের মাচা কিংবা সীমের ঝোপ সরিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকত। মাঠ জুড়ে সবুজ ধানের চারা বাতাসে মাথা দোলাত। মাঠ পেরিয়ে একটু দূরে যে নদীটা, সেটায় পাল খাটিয়ে নৌকো ভেসে যেত দূরে, দূরান্তরে।
তার কোনো পক্সক্ষীরাজ ঘোড়া ছিল না; ছিল না তেপান্তরের মাঠ পেরোবার তাড়া। সোনার হরিণ শিকারের কথা সে ভাবত না; সে কোনোদিন আদৌ হরিণই দেখেনি। তার মন জুড়ে ছিল না কোনো রাজকন্যে। মার মুখে রূপকথার গল্প শুনে সে রাজকন্যেকে ভাবতে চাইত। কিন্তু তার ছোট্ট কল্পনায় তাকে মনে হতো ভারী অচেনা আর অনেক দূরের। তারচে’ বরং পাশের বাড়ির ছোট্ট টুনটুনি পাখির মতো মেয়েটাকে তার ভালো লাগত। মেয়েটা তার সাথে খেলতে আসত মাঝে মধ্যে। ভারী মিষ্টি করে হাসতে পারত সে, আর অভিমান হলে ঠোঁট ফুলিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিত। সে খুব মজা পেত তার কাণ্ড দেখে।
তাদের ছিল তিনটে গরু আর দুটো ছাগল। তিনটে গরুর একটা গাই, গাইয়ের একটা বাছুরও ছিল। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তার বাবা দুধ দুইয়ে নিত। তার মা বলদদুটোকে খড়-কুড়ো খাইয়ে দিত বেশ করে। একটু পরেই তারা মাঠে যাবে লাঙল টানতে।
যেখানে তার বাড়ি, সে ছিল এক অপরূপ জায়গা। ভারী সুন্দর। এত সুন্দর জায়গা তোমরা আর দেখোনি। জায়গা তো নয়, সে ছিল এক দেশ। চারদিকে জল। পুবে, পশ্চিমে, উত্তরেÑযেদিকেই তাকাও না, নদী, ঘোলাটে জলের নদী। আর দক্ষিণে? দক্ষিণে ছিল সাগর, বিরাট বিশাল দুনিয়াজোড়া সাগর। গভীর নীল জলের ঢেউয়ের পর ঢেউজাগা সাগর।
ছেলেটি শুনেছিল তাদের নদী আর সাগরে ঘেরা দেশটির নাম স্বর্ণদ্বীপ। স্বর্ণদ্বীপ মানে সে জানত না, কিন্তু নামটা শুনতে তার ভীষণ ভালো লাগত। এত মিষ্টি নাম সে আর কখনো শোনেনি। নামটি শুনলে তার কানের ভেতর গানের সুরের মতো গুঞ্জন উঠত। তার তখন খুব সুন্দর, মিষ্টি আর আনন্দের কিছু ভাবতে ইচ্ছে হতো। ইচ্ছে করত ওই নামটিকে হালকা একটা ফুলের মত দু’আঙুলে ধরে নাকের কাছে এনে গন্ধ শোঁকে কিংবা ঘুঙুরের মতো কানের কাছে বাজিয়ে বাজিয়ে তার শব্দ শোনে।
তার বাবা দুধ দুইয়ে, পান্তা খেয়ে বলদদুটোকে নিয়ে মাঠে চলে যেত। খোঁয়ারের এক কোণে বেঁধে রাখা ছাগলদুটো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে ডাকত। তাদেরও যে বেরোবার সময় হলো!
ছেলেটি মার সাথে পান্তা ভাত খেয়ে ছাগলদুটো নিয়ে মাঠে চলে যেত। তরতাজা ঘাস দেখে ছাগলদুটো চরতে লেগে যেত আর সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের খাওয়া দেখত। তখন সোনালি রোদ্দুরে ঝকমক করত সারা মাঠ, আকাশটা চুপচাপ শান্ত চোখে চেয়ে থাকত মাটির দিকে। হালকা বাতাসে কচি ধানের নরম পাতাগুলো দুলত। লাল-সাদা-হলুদ রঙের প্রজাপতি উড়ত ঘাসের ফুলে ফুলে আর দূরের জঙ্গল থেকে ভেসে আসত দোয়েল, ঘুঘু কিংবা পাপিয়ার মিহিন শিস। মানুষেরা মাঠে কাজ করত, তাদের বিচিত্র কলরব শোনা যেত; ছেলেটি আনমনে দাঁড়িয়ে এসব দেখত আর শুনত। কী যে ভালো লাগত তার!
তারপর সে মাঠের এক প্রান্তে কাজ করতে থাকা তার বাবার কাছে চলে যেত। বাবা তাকে দেখে মিষ্টি করে হাসত। সে আলের ওপর বসে বাবার কাজ দেখত। কাজ করতে করতে বাবা গান গাইত। সে শুনত। বাবাকে মনে হতো তার অনেক বড় আর খুব ভালো।
এক সময় সে বলত, ‘বাড়ি যাবে না, বাবা?’
বাবা শুনে হাসত। ‘যাব, আগে কাজ শেষ করে নিই।’
সে বলত, ‘কাজ কেন করতে হয়, বাবা?’
বাবা গরুদুটোর লেজ মুচড়ে দিত হেট হেট করে। তারপর বলত, ‘কাজ করতে হবে না? দেখছ না সবাই কাজ করছে? কাজ না করলে খাব কোত্থেকে?’
ছেলেটি বলত, ‘তাইলে আমিও কাজ করব।’
বাবা হেসে বলত, ‘নিশ্চয় করবে। কিন্তু তুমি তো এখনো ছোট। আগে বড় হও। তারপরে কাজ করবে।’
বাবার সাথে কথা বলতে তার খুব ভালো লাগত। তার মিষ্টি হাসি আর আদরমাখানো কথায় মন ভরে উঠত। তার ভাবতে ভাল লাগত বড় হয়ে সেও বাবার সাথে মাঠে কাজ করছে। বাবার মতো সেও কোমরে গামছা পেঁচিয়ে হাল চষছে আর হেট হেট করে গরুদুটোর লেজ মুচড়ে দিচ্ছেÑএবং বাবার মতো সেও গান গাইছে ঠিক অমনি সুর করে টেনে টেনে, গলা কাঁপিয়ে।
এরপর সে বাড়ি ফিরে আসত। ফেরার পথে পাশের বাড়ির সে ছোট্ট মেয়েটির সাথে দেখা হতো তার। মেয়েটি তাকে দেখে ফিক করে হেসে দিত। ছেলেটিও হাসত। বলত, ‘আয়, খেলবি।’
মেয়েটি হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলত, ‘না, আমি বাড়ি যাব। বাড়িতে আমার কত্তো কাজ!’
ছেলেটি মুখ ভেঙচিয়ে বলত, ‘ইস! কত্তো কাজ! অ্যাত্তোটুকুন মেয়ে, তোর আবার কী কাজ বল তো?’
মেয়েটি রেগে উঠত। ‘বারে, কাজ নয় তো কী? আমাকে বুঝি রাঁধতে হবে না? ঘরদোর ঝাড়–...’
 ছেলেটি বলত, ‘ওসব তো করবে তোর মা। তুই অ্যাত্তোটুকুন পিচ্চি মেয়ে বুঝি রাঁধতে জানিস?’
মেয়েটি চোখ পাকিয়ে ধমক দিত, ‘খেপাবি না বলছি!’...তারপর হঠাৎ কী মনে করে খুশি হয়ে উঠত। ‘জানিস, আমি না তোকে খুঁজঁিছ...’
ছেলেটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করত, ‘কেন, বল তো?’
মেয়েটি কোচর থেকে চালভাজা বের করত। বলত, ‘তোর জন্য এনেছি।’
তারপর তারা দু’জনে বসে চালভাজা চিবোত। আর কত যে কথা বলত।
দুপুরে বাবা মাঠ থেকে ফিরলে সে বাবার সাথে বসে দুধ দিয়ে মেখে ভাত খেত। খেতে খেতে বলত, ‘আচ্ছা বাবা, গরুটা তে লাল, না? তাইলে লাল গাইয়ের দুধ অমন সাদা হয় কেন?’
বাবা তার কথা শুনে হাসতে হাসতে বিষম খেত।  মা তালপাতার পাখা নেড়ে বাতাস করতে করতে বলত, ‘দুধ লাল হলে তো রক্তের মতো লাগত, আর কালো হলে আলকাতরার মতো। এটাও বুঝিস না বেকুব!’
বিকেলে বাবা হাটে যেত। সে বাবাকে হাট থেকে মিষ্টি জিলিপি আনার ফরমাশ দিত। মা হাঁস-মুরগি ঘরে তুলে, গরু-ছাগল বেঁধে তারপর সাঁঝ নামতে বাতি জ্বালিয়ে দাওয়ায় বসে গল্প করত তার সাথে। কত্তো যে গল্প! শুধু কি রূপকথার? মা তার ছোটবেলার কথাও বলত। তার সঙ্গে মিশে থাকত স্বর্ণদ্বীপের গল্প।
স্বর্ণদ্বীপ! স্বর্ণদ্বীপ! ছেলেটির মন ভরে উঠত স্বর্ণদ্বীপের গল্প শুনতে শুনতে। মা বলত, ‘জানিস, আমাদের এই স্বর্ণদ্বীপের মতো দেশ দুনিয়ার কোথাও নেই।’
সে অবাক হয়ে শুনত মার গল্প। বলত, ‘সত্যিই মা ?’
মার মুখ সন্ধের অন্ধকারে মিটি মিটি জ্বলা বাতির আলোকে কেমন  চক চক করত। মা হাসত, তার পরণের কলাপাতারঙ শাড়ির মতো উজ্জ্বল আর প্রাণবন্ত সে হাসি। বলত, ‘হ্যাঁ-এ। আমাদের স্বর্ণদ্বীপে কোনো দুঃখ নেই। চারদিকে নদী, নদীভরা শুধু মাছ, এত্তো যে মাছ, সারাজীবন খেলেও তা আর ফুরোবে না।’
 ছেলেটি বলত, ‘আচ্ছা মা, স্বর্ণদ্বীপের চারদিকের নদী পেরোলে আর কী আছে? আর বুঝি কিছুই নেই?’
মা হেসে বলত, ‘থাকবে না কেন? তোর বাবা বলেছে, আরো কত দেশ আছে দুনিয়াতে। সেসব দেশের নাম নাকি চট্টগ্রাম, ঢাকা, বরিশাল...আরো কত কী?’
সে শুনে ভারী খুশি হয়ে উঠত। বলত, ‘আরো দেশ আছে? সত্যি ঢাকা, চট্টগ্রাম...মা, আমি বড় হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাব!’
মা তাকে বুকে চেপে ধরে টুক করে চুমু খেত গালে। বলত, ‘না, সোনা। তোকে আমি কোথাও যেতে দেব না। সব দেশের চেয়ে আমাদের স্বর্ণদ্বীপ ভাল। স্বর্ণদ্বীপ ছেড়ে আমরা কোথাও যাবো না কেমন?’
মার বুকে মুখ গুঁজে ছেলেটি কেমন এক সুখে গলে যেত কেবল। বিড় বিড় করে বলত, ‘হ্যাঁ মা, আমিও তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। কোত্থাও না।’
তখন সন্ধের অন্ধকারে ঘরের পাশের ঝোপের ভেতর ঝিঁঝিঁ ডাকত। জোনাকিরা আলোর বাতি জ্বেলে ঘুরে বেড়াত এই ঝোপ থেকে আরেক ঝোপে। গাব গাছের আগায় বাদুড় পাখা ঝাপটাত আর
এবং যেন কত্তো দূর থেকে শোনা যাচ্ছে, এমন কণ্ঠে বলত, ‘কিন্তু পশ্চিমের নদীটা এমন করে ভাঙছে কেন? পশ্চিমের নদীটা...’
হ্যাঁ, পশ্চিমের নদীটা, যে নদীটার দিকে মা কাজের ফাঁকে ফাঁকে লাউয়ের মাচা কিংবা সীমের ঝোপের ধারে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকত, সেটা খুব ভাঙছিল। সে নদীটা আগে আরো পশ্চিমে ছিল, অনে-ক পশ্চিমে। তখন সেটা ছিল খুব শান্ত আর ভারী লক্ষ্মী। মানুষেরা তার বুকে রঙ-বেরঙের  বাদাম খাটানো নৌকো ভাসাত। জেলেরা ধরতে যেত মাছ। তখন সে নদীটার মৃদু মৃদু ঢেউয়ে সোনালি সূর্যের আলো ঝিলমিল করত। গাঙচিলেরা উড়ে বেড়াত ঝাঁক বেঁধে। তারপর কী যে হলো। শান্ত আর লক্ষ্মী নদীটা একদিন ভীষণ খেপে গেল। অজগর সাপের মতো মোচড় খেতে শুরু করল তার বুক, পেট আর কোমর। যেন কতদিন কিছুই খায়নি সে, এমনি ভাবে টপাটপ গিলে খেতে শুরু করল মানুষের বাড়িঘর, ভিটেমাটি আর ফসলি মাঠ। ছেলেটির বাবা কাজ করত যে মাঠে, সে মাঠ খেল; তার মা যে উঠোনে ধান শুকোত, সে উঠোনটাও খেল। তাদের বাড়িঘর সব খেল এবং খেতে খেতে আরো পুবদিকে এগোল।
তারপর একদিন দেখা গেল স্বর্ণদ্বীপের সে ছেলেটি, যেখানে সে কোনোদিন আসবে না বলেছিল মার বুকে মুখ গুঁজে, সে ঢাকা না চট্টগ্রামের একটা রেলস্টেশনে বসে আছে একা। আরেকদিন দেখা গেল, সে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে একটা ফুটপাতে। তার মুখে হাসি নেই, চেহারায় ফ্যাকাসে, কতদিন যে সে পেট পুরে খেতে পায়নি। তার চোখে হলুদ পিঁচুটি,  আর চেখের তারায় মলিন বিষণœতা।
তোমরা যদি কেনোদিন ফুটপাত ধরে হাঁটো কিংবা রেল স্টেশনের কাছে যাও, তার সাথে তোমাদের দেখা হবে। তোমরা তখন তার সাথে কথা বলো, দেখবে সে তোমাকে তাদের সে হারানো স্বর্ণদ্বীপের গল্পই শোনাবে। সে লাল গাইয়ের সাদা দুধ, ফসলি জমি আর নিকোনো উঠোনে ধান শুকোনোর কথা বলবে। সারাজীবন খেলেও না ফুরোনো মাছের গল্প বলবে। বলতে বলতে তার চেখের পানি টপ টপ করে গাল বেয়ে ঝরে পড়বে আর তার বুক কাঁপা কাঁপা নিঃশ্বাসে ভেঙে যেতে চাইবে।
আচ্ছা, সে কি নতুন আরেকটা স্বর্ণদ্বীপের গল্প শুনতে চায়, যে স্বর্ণদ্বীপের কোনো নদী আর কোনোদিন মানুষের বাড়িঘর আর ফসলি জমি ভেঙে নেবে না? যে স্বর্ণদ্বীপের কোনো মানুষকেই কোনোদিন কোনো ফুটপাতে কিংবা রেল স্টেশনে বসে থাকতে হবে না?
নইলে কেন সে হারানো স্বর্ণদ্বীপের কথাই বলে বারবার?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন