জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১১

প্রমাণ (ওয়েস্টার্ন উপন্যাস










              এক

শ’চারেক গরু প্রায় দু'ঘণ্টা ধরে পরস্পরের সাথে ঠেলাঠেলি আর গুঁতোগুঁতি করছে। অবিরাম ক্রুদ্ধ, অসহিষ্ণু চিৎকারে কান ঝালাপালা। খুরের ঘায়ে শক্ত মাটি চূর্ণ বিচূর্ণ। বাতাসে ধুলোর চাদর।

শেষ গরুর পালটি করালে ঢুকতে অফিসে ফিরে চলল ইভান কেলভিন। ওর সাথে ছজন মরমন র‌্যাঞ্চার। করাল গেট পেরোনোর সময় কিশোর বয়সী কাউহ্যাণ্ডটার ওপর চোখ পড়ল ওর। আন্তরিক এক টুকরো হাসি উপহার দিল ও ছেলেটিকে।

গরুর পাল করালে ঢোকানোর সময় বেশ কয়েকবার ছেলেটাকে দেখেছে ও। ধুলোবালি উপেক্ষা করে বেড়ার পাশে দাঁড়িয়েছিল। পরনে নতুন কেনা কাউবয়ের পোশাক। বড় বড় চোখ মেলে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার মুখ দেখে ইভান কেন যেন নিজের ভেতর একধরনের টান অনুভব করেছিল।

‘কথাবার্তা শুরু করার আগে,’ নিজের মরমন সঙ্গীদের দিকে চাইল ও, ‘একটু গলা ভিজিয়ে নিলে মন্দ হয় না, কী বলো?’

কোনো জবাব পাওয়া গেল না মরমনদের তরফ থেকে। একটু হতাশ হলো ইভান। আমন্ত্রণটা জানাল ফের।

চওড়া কাঁধের দাড়িঅলা ক্যারি নামের একজন জবাব দিল এবার, ‘আমন্ত্রণের জন্যে ধন্যবাদ। কিন্তু মরমনরা মদ খায় না। শাস্ত্রে নিষেধ।’

‘বিশেষ করে,’ আরেকজন তথ্য জোগাল। ‘বিশপ যখন কাছে পিঠে থাকে।’ হাসল সে। ‘আর ক্যারি হচ্ছে আমাদের বিশপ।’

‘ঠিক আছে। কারও ধর্মে নিষিদ্ধ কোনও কাজে আহ্বান করাটা আমারও নীতিবিরুদ্ধ। আমি তোমাদের নীতি ও আদর্শকে সম্মান করি। তবে সিগারে আপত্তি নেই নিশ্চয় কারও?’

এই প্রস্তাবে মরমনরা একে অন্যের দিকে তাকাল। ক্যারিই জবাব দিল, ‘আবারও ধন্যবাদ। কিন্তু সিগারও আমাদের ধর্মে নিষিদ্ধ।’

‘মাফ করে দাও, ভাই। আমি আবার ভুল করলাম। আচ্ছা, তোমাদের সবাইকে যদি একটা করে লীড পেন্সিল কিনে দিই, তাতেও কি তোমাদের ধর্মের বাধা থাকবে?’

এবার সমস্বরে হেসে উঠল মরমনরা।

এরই মধ্যে দু’জন তরুণ এসে যোগ দিয়েছে ওদের সঙ্গে। ঘোড়ার পিঠ থেকে ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে করালের বেড়ার ওপর দিয়ে গরুগুলোকে দেখছিল ওরা। এক তরুণ  ঘাড় ফেরাল  ইভানের দিকে। ‘তুমি যদি পান করানোর জন্যে কাউকে চাও, তাহলে আমরা দু’জন তোমার সাথে বসতে রাজি আছি, ব্রাদার।’

সকৌতুকে তাকাল ইভান ছেলেটার দিকে। ওদের দু’জনের পরনেই কাউবয়ের পোশাক। ট্রেইলের ধুলোয় ধূসর রঙ ধরেছে মাথায় চওড়া ব্রিমের হ্যাট থেকে বুটের ডগা পর্যন্ত। ঘামে ভেজা ক্লাস্ত ঘোড়াগুলোকে মনে হচ্ছে বহুদূর পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে ওগুলো।

দু’জনই সুদর্শন, তবে দু’জনের চেহারায় কঠিন ও শয়তানি ভাবটাও নজর এড়াল না ইভানের। আলগোছে কাঁধ ঝাঁকাল ও। হালকা গলায় বলল, ‘বেশ তো ভায়েরা। একটু অপেক্ষা করো। এক্ষুনি আমার বন্ধুদের সাথে ব্যবসায়িক কাজ সেরে তোমাদের নিয়ে সেলুনে বসব।’

‘ঠিক আছে। আমরা অপেক্ষা করব।’ রাজি হলো দুই তরুণ। দু’জনে এক সাথে ঘোড়া ফিরিয়ে নিয়ে কাছের সেলুনটার দিকে চলল।

‘আ..হে..ম!’ সশব্দে গলা পরিষ্কার করল বিশপ ক্যারি। ‘তুমি কী করবে, সেটা নিশ্চয় তোমার নিজেরই সিদ্ধান্ত, বন্ধু। তবে আমি হলে এ-ধরনের লোকের ব্যাপারে সাবধান থাকতাম।’

‘তাই?’ জিজ্ঞাসু চোখে বিশপের দিকে চাইল ইভান। ‘তুমি চেন ওদের?’

‘না, চিনি না। কারিভাইলে এরা নতুন। তবে তুমি হয়তো ওয়াইল্ড ওয়ান-এর নাম শুনে থাকবে...’

‘কে শোনেনি বলো?’ হাসল ইভান।

‘তুমি এখন ওয়াইল্ড ওয়ান-এর সীমানায় ঢুকে পড়েছ,’ ক্যারি বলে চলল। ‘এখানে এমন অনেক লোক আছে, যারা স্বেচ্ছায় না-হলেও ক্লার্ক হফম্যান ও তার লোকদের পক্ষে কাজ করে, প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা দেয়। তুমি একজন গরুক্রেতা, যেভাবে সারাদেশ চষে বেড়াচ্ছ, তাতে ওয়াইল্ড ওয়ান তোমার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠবেই। তোমার প্রতিটি পদক্ষেপের খবর নেবে।’

‘আচ্ছা।’ গম্ভীর হলো ইভান। ক্যারির হুশিয়ারি উড়িয়ে দেয়ার মত মনে হচ্ছে না। বিশপ যা বলেছে, তা অত্যন্ত পরিষ্কার। ‘তুমি বলতে চাইছ, ওই দুই তরুণ ওয়াইল্ড ওয়ান-এর হয়ে কাজ করছে? ওর চেলা?’

‘হতে পারে।’

‘ঠিক আছে, ধন্যবাদ। আমি সাবধান থাকব।’

মরমনদের নিয়ে নিজের অফিসে গেল সে। প্রত্যেককে আইডাহো ল্যাণ্ড অ্যাণ্ড লাইভস্টিক কোম্পানির একটা করে ড্রাফট দিল। ওদের সবগুলো গরু কিনে নিয়েছে ও। এই ড্রাফট যে কোনও ওয়েস্টার্ন ব্যাংকে সোনার মতই মূল্যবান। বিনা বাক্যব্যয়ে গ্রহণ করবে সবাই।

মরমনদের সঙ্গে ব্যবসা শেষ করে অফিস থেকে বেরোল সে। রাস্তা পেরিয়ে ওপাশের সেলুনে গিয়ে ঢুকল। সকাল থেকে গরু কেনা আর সেগুলো করালে ঢোকানোর কাজ তদারক করতে গিয়ে গাধার মত খেটেছে। একগাদা ধুলো গিলে ফেলেছে ও। তৃষ্ণায় গলা ফাটার উপক্রম।

সারা দিনে আরও কয়েকবার পান করে গেছে ইভান। বারটেণ্ডারের সঙ্গে মোটামুটি ভাব জমিয়ে ফেলেছে। এখন ঢুকতে দুই তরুণকে দেখতে পেল। বসে আছে ওরা। ক্যারি এদের ব্যাপারে সতর্ক করতে চেয়েছে ওকে। বলেছিল গ্লাস ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারে হুশিয়ার থাকতে।

ওকে দেখে দু’তরুণ বার থেকে দুটো গ্লাস নামিয়ে সশব্দে রাখল টেবিলের ওপর। তারপর এক সাথে স্বাগত জানাল, ‘ঠিক সময় মত পৌঁছে গেছ তুমি, মিস্টার। তোমার জন্যে কী বলব?’

‘বীয়ার।’ মৃদু হাসল ইভান অভ্যর্থনার জবাবে।

নিজেদের গ্লাসে মদ ঢালল ওরা। পান করতে শুরু করল। ইভান দাম দেবার আগেই দু’জনের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশি কথা বলা তরুণ পকেট থেকে এক টুকরো সোনা বের করে বারের ওপর রাখল। ‘গরু কিনছ, না?’ জিজ্ঞেস করল ইভানকে।

‘বলতে পার,’ স্বীকার করল ইভান। ‘মাঝে মধ্যে এখানে ওখানে সুযোগ পেলে কিনে ফেলি।’ গ্লাস খালি করে বলল, ‘পরের বার আমাকে দাম দেয়ার সুযোগ দাও। কী খাবে তোমরা?’

‘হুইস্কি,’ জবাব দিল একজন। অন্যজন হাসল।

পান শেষ করে সিগার অফার করল ইভান। একজন বলল, ‘মিস্টার, তুমি যদি গরু কিনতে চাও, তা হলে বলব ঠিক জায়গাতেই এসেছ। তবে তার আগে তোমার সাথে পরিচয় পর্বটা সেরে ফেলি। আমি জ্যাক ফোসাম। আর আমার সাথের থালামুখোর নাম আল বিগার্স।’

‘তোমাদের সাথে পরিচিত হয়ে সত্যিই খুশি হয়েছি,’ হৃদ্যতা প্রকাশ পেল ইভানের গলায়। ‘আমি ইভান কেলভিন।’

‘আমরাও খুশি, ইভান। বারকীপ,’ গলা চড়াল থালামুখো বিগার্স। ‘গ্লাস ভরে দাও সবার।’

‘তোমরা গরুর কথা বলছিলে...’ স্মরণ করিয়ে দিল ইভান।

‘এই মাত্র বারকীপ বলছিল তুমি নাকি প্রায় পাঁচশ’ গরু কিনে ফেলেছ মরমনদের কাছ থেকে। তুমি কি আরও কিনতে চাও?’

‘আমার সেরকমই ইচ্ছে,’ স্বীকার করল ইভান। ‘আইডাহো রেঞ্জের জন্যে আরও দুই থেকে আড়াই হাজার গরু কিনব। ওরা বলেছে, দক্ষিণ উতাহ্ অঞ্চলের ছোট্ট সাইজের গরুগুলো ভাল। অনেকটা টেক্সান লংহর্নের মত।’

‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। এখানকার গরুগুলোর পাছা এত হালকা যে, তারা ইচ্ছে করলে নীচের দিকে মাথা রেখে পাছা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে,’ ফোসাম মন্তব্য করল গম্ভীর স্বরে।

ওর রসিকতায় গলা ফাটিয়ে হাসল বারকীপার। ইভান নিজেও হাসি সামলাতে পারল না।

‘এতে সমস্যা কেবল একটাই,’ সামনের পাহাড়গুলোর দিকে আঙুল উঁচাল বিগার্স। ‘তুমি রয়েছ পাহাড়ের এ-পাশে। এখান থেকে একশ’ মাইল পুবে যদি যেতে পার, তা হলে যে ধরনের গরু চাও, দেখাতে পারব। যা চাও, তার পুরোটাই ওখানে পাবে তুমি। এখানকার চাইতে অনেক সস্তায়।’

‘এখান থেকে ওদিকে যাওয়ার পথ আছে?’ জানতে চাইল ইভান।

‘অবশ্যই আছে। আমরা তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব। তুমি আমাদের সাথে যাবে। সব কিছু নিজের চোখে দেখবে। তুমি যেরকম চাইছ, তারচে’ সরস গরু যদি না-পাও, তা হলে ড্রিঙ্কের সব খরচা আমার।’

‘আমি আসলে দক্ষিণে যাবার কথা ভাবছি,’ ইভান বলল। ‘এখানে আমার শ’চারেক গরু কেনা হয়ে গেছে। চালান দেয়ার মত একটা পাল  হয়ে গেছে নিশ্চয়।’

‘আরে আল, তুমি নিশ্চয় ভুলে গেছ যে, পাইপ ¯িপ্রংয়ে আমাদের কাজ রয়েছে,’ হঠাৎ বলে উঠল জ্যাক। ‘ওখানে গেলে আমরা এক হপ্তা পরেও ফিরতে পারব না।’

জিভ কাটার ভঙ্গি করল আল। ‘ঠিক বলেছ।’ ইভানের দিকে চাইল লজ্জিত ভাবে। ‘আমি সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম।’

‘আমি আসলে দক্ষিণেই যাব,’ ওকে আশ্বস্ত করল ইভান। ‘আমার পালের পরিমাণ গরু হয়ে গেছে। না হলে অবশ্য...’ থামল ইভান। কাঁধ ঝাঁকাল।

‘না না, তুমি যাও,’ পরামর্শ দিল ফোসাম। ‘আমি চাই প্রতি গরুতে তোমার দু’ডলার বাঁচুক। আর ওদিক দিয়ে তোমার ট্রেইলটাও অনেক সহজ হবে। কেলভিন, আমি কী বলি শোনো। তুমি গিয়ে হ্যাঙ্ক স্টিভেন্সের সঙ্গে দেখা করো। ওর র‌্যাঞ্চ আছে ক্যাটল ভ্যালিতে। ওর কাছে না হলেও দু’তিন হাজার গরু পাওয়ার কথা তোমার। তুমি যদি আরও বেশি চাও, তা হলে সে জন্যে কোথায় যেতে হবে, তাও বলে দেবে তোমাকে। আর আমরা ওখান থেকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে আইএক্সএল র‌্যাঞ্চে কাজ করি। এই মুহূর্তে আমাদের বসের জন্যে কিছু ঘোড়া কিনতে যাচ্ছি পাইপ ¯িপ্রংয়ে।’

‘তোমাদের পরামর্শ তো ভালই মনে হচ্ছে,’ মাথা নাড়ল ইভান। ‘বেশ, আমি চিন্তা-ভাবনা করে দেখব।’

এরপর আরেক পালা ড্রিঙ্ক হলো। তারপর দুই তরুণকে বিদায় দিয়ে করালে ফিরে গেল ইভান। ওখানে মরমনদের কাছ থেকে কেনা গরুগুলোর দেখাশোনা করছে এক মরমন র‌্যাঞ্চার আর তার দুই ছেলে। গরুগুলো চালান করে দেয়ার আগ পর্যন্ত মরমনদের চারণভূমিতেই ওগুলো চরানোর বন্দোবস্ত করে নিয়েছে ইভান। গরুগুলো কৃশ, কোমর হাড্ডিসার, চোখে বুনো দৃষ্টি। তারস্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে করাল গেট ভেঙে বেরোবার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ছাড়া পেতেই দুদ্দাড় করে ছুটল লেজ তুলে। বাতাসে ধুলোর ঝড় উঠল।

খুব ভাল একটা গরুর পাল হয়েছে, ভাবল ইভান। তবে দাম যা আশা করেছিল, তারচে’ একটু বেশি দিয়ে ফেলেছে। এটাই তার প্রথম চালান। এখন খুব একটা হৃষ্টপুষ্ট নয়, তবে আশা করছে আইডাহো কিংবা মণ্টানার ঘেসো ভূমিতে নিয়ে যেতে পারলে তরতাজা ঘাস খেয়ে তাড়াতাড়ি  মোটাতাজা হয়ে উঠবে। গরুগুলোর বয়স বেশি নয়।

তরুণ দুই কাউপাঞ্চারের কথাগুলো এখনো কানে বাজছে ইভানের। তবে তাদের পরামর্শ মত কাজ করার ইচ্ছে ওর নেই। দু’জনের কথাবার্তা ও আচার-আচরণের ধরনে কাউপাঞ্চারের চেয়ে আউটল’ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি মনে হয়। ইভান এধরনের লোকের ব্যাপারে আনাড়ি নয়। তবে ওরা যা বলেছে, তাতে অবিশ্বাস করাও শক্ত। কিন্তু ট্রেইলে নিজের কাজে যদি সে খুব বেশি দক্ষতা দেখাতে না-পারে, তাহলে তারা সহজে ওর কাছ থেকে গরুগুলো কেড়ে নিতে পারবে।

গরুগুলোর দায়িত্বে থাকা মরমনকে কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিল সে। তারপর নিজের  হোটেলের দিকে রওনা হলো। হঠাৎ বেড়ার কাছে দাঁড়ানো আগের সে-ছেলেটার দিকে নজর গেল ওর। ছেলেটা ্এখনও অপসৃয়মান গরুগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চকচকে আগ্রহ।

‘ওগুলো কি তোমার গরু?’ ইভানের চোখে চোখ রাখল ও।

‘হ্যাঁ, বাছা,’ বলল ইভান। ‘আমার মনে হয় গরুগুলো আমারই। ’

‘তাহলে তুমি একজন ক্যাটলম্যান?’

‘না, এটা কিন্তু মনে হয় না।’ হাসল ইভান। ‘আমি স্রেফ একজন গরুক্রেতা। একটা কোম্পানির জন্যে কিনে নিচ্ছি এগুলো।’

‘তাহলে তুমি এখানকার কেউ নও।’

‘আমারও সে রকম ধারণা। তা তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’

‘আমি জানি না,’ নিচু গলায় জবাব দিল ছেলেটা। ‘আমি আর আমার বোন এখানে আমাদের বড় ভাইকে খুঁজতে এসেছি। এখানে সে আইএক্সএল নামের একটি বড় আউটফিটের মালিক। জায়গাটা হাইরিভারের কাছাকাছি। কারণ ওখান থেকেই সে আমাদের কাছে চিঠিপত্র লিখত। গত একবছর ধরে ওর কাছ থেকে কোনও চিঠিপত্র পাচ্ছি না। তাই আমি আর আমার বোন ওর খোঁজে এসেছি। জানতে চাই ওর কী হয়েছে।’

‘তাহলে তো কোথায় যাচ্ছ, সেটা তোমাদের জানা উচিত,’ মন্তব্য করল ইভান।

‘মুশকিল হলো, সবাই বলছে কাজটা নাকি আমরা বোকামি করছি। এখানকার এক লোক, ক্যারি নামের একজন মরমন পাদ্রী, পরিষ্কার বলে দিয়েছে হাইরিভার জায়গাটা নাকি কোনও সুন্দরী মেয়ের জন্যে ভাল জায়গা নয়। আর সে এও বলেছে আইএক্সএল-এর মালিক নাকি ব্র“ম নামের এক লোক। আর কেউ নাকি আমার ভাইয়ের নামও শোনেনি।’

‘কী নাম তোমার ভাইয়ের?’

‘চার্লস হ্যারিসন। আমি বাড হ্যারিসন,’ নিজের নাম বলল ছেলেটা। ‘আর আমার বোন মেলিন্দা।...ও বোধ হয় আমাকে ডাকছে। আচ্ছা, ঠিক আছে। আমার বোধ হয় এখন  যাওয়া উচিত। আমরা ওখানে যাওয়ার জন্যে বেশ কিছু মালপত্র কিনেছি। ওখানে গিয়ে দেখতে চাই চার্লির কী হয়েছ্।ে মেলিন্দা ভয় পাচ্ছে, ও হয়তো আর বেঁচে নেই। ঠিক আছে, আসি।’

‘দাঁড়াও, এক মিনিট। তোমরা কি জান তোমাদের কতদূর যেতে হবে?’

‘ওরা বলেছে প্রায় একশ’ মাইল।’ হাসল বাড।

‘তোমাদের সঙ্গে এমন কেউ আছে যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে?’

‘বাকবোর্ড চালানোর জন্যে একজন বুড়ো আছে। রান্নাবান্নার কাজটাও সে-ই করে। ও বলে ওর নাম নাকি নেভাদা। লোকটা একটু অদ্ভুত আছে।'

‘তা তোমরা কি এখনই যাত্রা শুরু করবে?’

‘হ্যাঁ। আমাদের বাকবোর্ডটা রওনা শুরু করার জন্যে তৈরি।’

‘ব্যাপারটাকে কাকতালীয় বলে ধরে নিতে পার,’ বলল ইভান। ‘আমিও নিজেও আসলে ওদিকেই যাচ্ছি। ওখানে আরও কিছু গরু কিনব। তোমরা ওখানে পৌঁছার আগেই হয়তো পথে তোমাদের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে।’

‘তাহলে তো চমৎকার হবে।’ খুশি হলো বাড। ‘আমাদের ক্যাম্পের পাশে তোমাকে পেলে  ভালই লাগবে।’

হোটেলের দিকে চলতে চলতে মেয়েটাকে দেখল ইভান। মেয়েটার মাথায় হালকা হলুদ রঙের চুল; সুশ্রী মুখ। বয়স বিশের বেশি নয়। বাকবোর্ডে চড়তে যাচ্ছে মেয়েটা। পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন। মরুভূমির বুড়ো ইঁদুরের রঙ লোকটার গায়ে, মুখে উস্কখুস্ক দাড়ি। মেয়েটাকে পশ্চিমে নবাগতই মনে হচ্ছে। তবে ওর নড়াচড়ায় জড়সড় ভঙ্গি নেই দেখে ভাল লাগল ইভানের। এই মেয়ে টিকে যাবে এখানে, মৃদু হেসে ভাবল সে।

কিছুক্ষণ আগেও পাহাড় পেরোনোর মতলব ছিল না ইভানের। সিদ্ধান্তটা ধরতে গেলে আচমকাই নিয়ে ফেলেছে সে। এর মূলে কাজ করেছে অবশ্য ওর নতুন পরিচিত বন্ধু ফোসাম আর বিগার্সের আইএক্সএল-এ কাজ করার খবরটাই। এরা যে এখন এই শহরেÑ খবরটা বাডকে বলবে কিনা ভাবল একবার। পরে চিন্তাটা বাতিল করে দিল।

দুই কাউপাঞ্চার এখনও কারিভাইল ছেড়ে যায়নি। জানে, ওর অনুপস্থিতিতে সেলুনে বসে ঠেসে হুইস্কি গিলছে। ও ঢোকামাত্র হই হই করে উঠল ওরা। সরবে অভিনন্দন জানাল ওকে। নিজের সাথে ওদের জন্যেও ফের অর্ডার দিল ইভান। তারপর জিজ্ঞাসু চোখে চাইল ওদের দিকে। ‘আইএক্সএল-এ কদ্দিন ধরে কাজ করছ তোমরা?’

‘ওহ,’ একগাল হাসল ফোসাম। ‘তা হবে প্রায় বছর পাঁচেক।’

‘তাই? বেশ তা হলে বলো তো চার্লস হ্যারিসন ওখানে কী করে?’

‘হ্যারিসন? কই, এই নাম তো কখনও শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। আল, তোমার?’

 ‘নাহ্,’ মাথা নাড়ল আল বিগার্স। ‘আমিও কখনও ওখানে হ্যারিসন নামের কারও কথা শুনিনি।’ ইভানের দিকে চাইল। ‘হঠাৎ এই নাম?’

‘না মানে..হঠাৎ একজনের কাছে শোনলাম নামটা। বলল, ওই লোক নাকি, তোমরা যা বলেছ, তারচে’ আরও অনেক সস্তায় গরু দিতে পারবে। তোমাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার আরও অনেক আগেই তার কাছে পেয়েছি আমি খবরটা,’ সত্যি কথাটা বলল না ইভান।

‘দেখতে কী রকম লোকটা? আকার আকৃতি...’

‘উম-ম..’ এক মুহূর্ত টিন্তা করল ইভান। একটা সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করল। ‘আমি যতটা মনে করতে পারছি লোকটা লম্বা। উচ্চতায় ছয় ফুটের চেয়ে সামান্য কম। ঢেউখেলানো বাদামী চুল, বাদামী চোখ। খাড়া নাক, মুখটা বড় আর...চিবুকের ওপর তিলের মত কিছু একটা আছে।’

‘এবং নাক থেকে ওপরের দিকে বাম চোখের নীচে কাটাদাগ আছে একটা?’ আগ্রহের সাথে জানতে চাইল ফোসাম।

‘মনে হয়, ঠিক বলেছ,’ সায় দিল ইভান। পর মুহূর্তে টের পেল টেবিলের নীচে ফোসামের পায়ে বিগার্সের লাথিটা।

‘তুমি নিশ্চয় নামটা ভুল করছ, ফ্রেন্ড,’ মুখে বলল সে। ‘যে-লোকের কথা বলছ, ওর নাম হ্যারিসন নয়, জনসন। আর ও এখন ওখানে নেই।’

ইভান বুঝতে পারল, এরপর আর লোকগুলোর মুখ থেকে কোনও কথা বের করা যাবে না। তবে যেটুকু শুনেছে, এর মধ্যে আইএক্সএল র‌্যাঞ্চ নিয়ে চিন্তা-ভাবনার কিছুটা খোরাক পাওয়া গেছে।

তবে প্রয়োজনটা বাড হ্যারিসন আর তার বোনের। ওর নিজের কোনও স্বার্থ নেই। অনেক দিনের অভিজ্ঞতা থেকে সে শিখেছে, যার ঝামেলা তাকেই সামলাতে দেয়া উচিত। তবুও একটা প্রায় বাচ্চা ছেলে তার সুন্দরী তরুণী বোনকে নিয়ে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় অমন একটা বেয়াড়া পরিবেশে গিয়ে পড়–ক, তাও ভাবতে ভাল লাগছে না ওর। কারণ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ওরা যেখানে যাচ্ছে, জায়গাটা ভাল নয়। অন্তত কোনও ভদ্রঘরের অল্প বয়েসী দুটি ছেলেমেয়ের জন্যে। ওটা একটা কুখ্যাত আউটল’ এলাকা। সুতরাং পাহাড়ের ভেতর দিয়ে ওই এলাকায় ওদিকে যাওয়ার ব্যাপারে সেও একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাচ্ছে এখন।

‘মনে হয়,’ মৃদু স্বরে বলল ও। ‘তোমাদের পরামর্শ মতই কাজ করা উচিত আমার। কাল সকালে উঠেই আমি হাইরিভারের উদ্দেশে যাত্রা করব।’

‘কথা দিচ্ছি সে জন্যে তোমাকে একটুুও পস্তাতে হবে না,’ আমুদে গলায় বলল বিগার্স।

ওদের চোখগুলো খুশিতে জ্বল জ্বল করছে দেখতে পেল দেখল ইভান। মদ খেয়ে প্রায় মাতাল হয়ে পড়েছে ওরা। মনের ভাব লুকোতে পারার মত কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে।

‘আজ রাতে আমি বিশপ ক্যারির ওখানে থাকব। সুতরাং তোমাদের আর দেখা নাও হতে পারে।’

‘আরে না!’ হেসে উঠল বিগার্স। ‘আবার দেখা হবে তোমার সঙ্গে। নিশ্চিন্ত থাকতে পার তুমি এ-ব্যাপারে। ঠিক আছে, তাহলে এবার উঠতে হয়।’

শেষবারের মত একত্রে পান করল ওরা। তারপর বিদায় নিল ইভান।

গরু কেনার জন্যে বেরোলে সব সময় নিজের ঘোড়ায় চড়ে ও।  ওর ঘোড়াটা লম্বামুখো, ধূসর; চোখদুটো কাচের মত উজ্জ্বল চকচকে। ছোটার জন্যে পাগল হয়ে থাকে সারাক্ষণ। দিনের পর দিন পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তর মাইল হেসে খেলে চলতে পারে।  ইভান ওকে ম্ইাক বলে ডাকে।

শহর থেকে বেরোনোর একটু পরেই নিজের গতিপথ বদলাল সে। সরু ওয়্যাগন রোড ধরে ফের এগোল। রাস্তাটা চলে গেছে পেনোলোয়া ক্যানিয়নের দিকে। এলাকাটা খোলামেলা। রাস্তা ছেড়ে একটু দূর দিয়ে এগোচ্ছে ও। ক্যানিয়নের মুখে পৌঁছানোর আগে মাইককে হণ্টন গতিতে চলতে দিল। ক্যানিয়নের ভেতরটা হালকা ঝোপঝাড় আর ছোট ছোট গাছগাছড়ায় ভরা।

হ্যারিসনদের বাকবোর্ডটা চোখে পড়তে ঘোড়ার গতি থামাল ও। ওদের গাইডকে ক্যানিয়ন থেকে সিকি মাইল দূর দিয়ে বাকবোর্ড নিয়ে যেতে দেখল। একটা বাঁক ঘুরতে চোখের  আড়াল হয়ে গেল ওটা।

রাস্তার পাশে একটা ঘন ঝোপের ভেতর ঢুকে গেল গেল ও মাইককে নিয়ে। এমন একটা জায়গা বেছে নিল, যেখানে লুকিয়ে থাকলে ঘোড়াটা কারও চোখে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে না। কিন্তু ও নিজে রাস্তার ওপর একটা চোখ রাখতে পারবে।

প্রায় এক ঘণ্টা পরে ধৈর্যের ফল ফলল। আল বিগার্স ও জ্যাক ফোসামকে দেখা গেল আসতে। অভ্যস্ত ভঙ্গিতে আসছে ওরা। মনেই হচ্ছে না এই এলাকায় ওরা তারই মত আগন্তুক। যেন এলাকার প্রতিটি ইঞ্চিই ওদের নখদর্পণে। এত দূর থেকেও ওদের মুখের ভাব পড়তে পারছে ইভান। খুশিতে রীতিমত টৈ টুম্বুর দুই পাঞ্চার।

ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি ফুটল ইভানের। স্বল্প পরিচিত দুই পাঞ্চার বন্ধুর প্রতি ওর মনে বিশেষ কোনও বিদ্বেষভাব নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে স্রেফ পাজি লোক ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না ওদের। ওর সাথে চালাকি করতে চেয়েছে ওরা। যে পথে যাবার কথা, সে পথে না-গিয়ে তার বিপরীত দিকের পথে চলে এসেছে। অর্থাৎ যেদিক থেকে গিয়েছে, ফের সেদিকে ফিরে চলেছে। এর মানে কী হতে পারে, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না ইভানের।

আচমকা ঠোঁটের কোন থেকে হাসি মুছে গেল ওর। সামনে বাকবোর্ডে চড়া লোকগুলোর কথা মনে হলো।

দুই রাইডার চোখের আড়াল হয়ে যেতে মাইককে নিয়ে ঝোপ থেকে বেরোল সে। তারপর ধীরে সুস্থে এগোল ক্যানিয়নের উদ্দেশে।





দুই


বাকবোর্ড তৈরি। এখনই যাত্রা শুরু করবে মেলিন্দারা। ছোট ভাইয়ের ওপর রেগে টং হয়ে আছে মেলিন্দা। পাজিটা শহরে গিয়ে অনর্থক আড্ডা মেরে সময় নষ্ট করছে। মালপত্র বোঝাই বাকবোর্ডের পাশে অস্থির ভাবে পায়চারী করছে ও। একটু পরে বাড এসে হাজির হলো।

‘বাড,’ ছোটভাইকে দেখে বকুনি লাগাল, ‘তোমার কি মনে হয় না যে, নষ্ট করার মত যথেষ্ট সময় আমাদের নেই! নেভাডা বলেছে, ও যেখানে ক্যাম্প করার কথা ভাবছে, সেখানে পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে।’

‘বারে! আমি তো মাত্র এক মিনিট দেরি করেছি,’ আত্মপক্ষ সমর্থন করল বাড। ‘আমি ওই গরুক্রেতার সাথে কথা বলছিলাম। ভেবেছিলাম, ও হয়তো চার্লি সম্পর্কে কিছু শুনে থাকবে।’

‘শুনেছে নাকি ও?’ আগ্রহ ফুটল মেলিন্দার গলায়।

‘না। তবে বলেছে, ও নিজেও নাকি হাইরিভার অঞ্চলে যাচ্ছে। আমি ওকে আমাদের সঙ্গে ক্যাম্প করতে বলেছি।’

‘তোমার ওটা বলা উচিত হয়নি।’ অসন্তোষ প্রকাশ করল বোন। ‘এখানে আসার পর থেকে আমার কেন জানি ভয় করছে। নিশ্চিত বুঝতে পারছি চার্লির ভাগ্যে খারাপ কিছু ঘটেছে।’

‘তুমি যাদের সাথে যাচ্ছ,’ সশব্দে গলা পরিষ্কার করে নিল বুড়ো নেভাদা। ‘তাদের ব্যাপারে আরও সতর্ক হওয়া উচিত, মিজ। শুনেছি, এদিকে ওয়াইল্ড ওয়ানের চরেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তুমি কীভাবে বুঝবে কে তাদের চর আর কে নয়?’

‘কিন্তু এই লোক এদিকের কেউ নয়,’ বাড নাছোড়বান্দা। নেভাডার যুক্তি মেনে নিতে পারছে না। ‘ও তো আমাদের মতই আগন্তুক। সে কী করে ওয়াইল্ড ওয়ানের চর হবে?’

‘কোন কিছুই নিশ্চিত করে বলা যাবে না।’ ছোটভাইয়ের যুক্তি নাকচ করে দিল মেলিন্দা। ‘তবে আমি ওয়াইল্ড ওয়ানের ব্যাপারে ভয় পাচ্ছি। ওরা..ওরা হয়তো...চার্লিকে খুন করেছে।’ নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করছে মেলিন্দা, তবু শেষ দিকে গলা ধরে এল ওর। ‘নইলে এতদিনে নিশ্চয় ওর খবর পেতাম।’

‘না না,’ বোনকে সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে বলল বাড। ‘ও নিশ্চয় ভাল আছে। আসলে ও হয়তো কাজে-কর্মে ভীষণ ব্যস্ত। তাই আমাদের কাছে চিঠি লেখার সময় পাচ্ছে না।’

্আনমনে শিস দিল নেভাডা। প্রতিবাদ করছে না বাডের কথায়। তবে ওর শিসের ধরনে বোঝা যাচ্ছে, ভাই-বোনের মত আশাবাদী হওয়ার কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছে না সে। হ্যারিসনকে খুঁজতে যাওয়ার ফল কী হতে পারে, সে আগেই তাদের বলে দিয়েছে। তার মতে, মেলিন্দারা স্রেফ অন্ধকারেই একটা কালো বেড়াল খুঁজতে বেরিয়েছে।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে রেগে গেল মেলিন্দা। তাড়া লাগাল বুড়োকে, ‘তুমি কি এবার দয়া করে রওনা দেবে?’

‘অবশ্যই,’ শিস থামাল নেভাডা। আমুদে গলায় বলল, ‘তোমরা সবাই আসার জন্যে তো এতক্ষণ দেরি করলাম।’

বাকবোর্ডের একটিমাত্র আসনে তিনজনকে প্রায় ঠাসাঠাসি করে বসতে হলো ওদের। ছোট বাকবোর্ডটি মালপত্রে পুরোটাই বোঝাই। অবশ্য মালপত্র বলতেও তেমন কিছু নেই। মেলিন্দার ইচ্ছে, পথে কোনও গ্রাম বা ছোট শহর টহর পড়লে সম্ভব হলে কম দামে প্রয়োজনীয় মালপত্র কিনবে।

তাদের জন্যে এখন টাকা বাঁচানোটাও একটা জরুরি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। হ্যারিসন পরিবার ছিল নিউইয়র্কের বনেদি আর সম্মানিত পরিবারগুলোর একটি। কখনো তাদের উল্লেখ করার মত বেশি টাকা ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাগ্য ফেরানোর আশায় পশ্চিমে যাত্রা করার আগ পর্যন্ত নিজেদের মানিয়ে নিয়ে এসেছে সেখানে।

মাত্র মাস পাঁচেক আগে মিসেস হ্যারিসন মারা যান। তার দু’মাস আগে মারা গিয়েছিলেন মি. হ্যারিসন। প্রায় বছর পাঁচেক আগে পরিবারের বড় ছেলে পশ্চিমে চলে গিয়েছিল। মি. আর মিসেস হ্যারিসন তার খবর পেতে অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু স্রেফ লাপাত্তা হয়ে গেছে যেন ছেলেটা।

মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হওয়ার দিনকয়েক পরই পারিবারিক উকিল মেলিন্দাকে দুঃসংবাদটা দিয়েছিল। তার বাবা মারা যাওয়ার আগে এক গাদা ধার-কর্জ করে গিয়েছিলেন। সেসব ধার শুধতে হলে তাদের বাড়িঘর আর আসবাবপত্র বিক্রি করে দেয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই।

শেষ পর্যন্ত তা-ই করতে হলো মেলিন্দাকে। বাড়ি বিক্রি করে ধার-কর্জ শোধ করার পর হাজার খানেক ডলারের বেশি বাঁচল না। এরপর ভাইকে খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নিল মেলিন্দা আর বাড।

তাদের ভাই চার্লি হ্যারিসন সুদর্শন, স্মার্ট আর  প্রাণচঞ্চল এক যুবক। পশ্চিমে চলে যাওয়ার পর বারকয়েক মাত্র বাড়িতে এসেছিল। প্রচুর টাকা-পয়সা থাকত ওর সঙ্গে। যখন তখন যাকে তাকে নিজের র‌্যাঞ্চের গল্প শোনাত। ছোট্ট বাড এসব গল্প শুনে হাঁ করে গিলত। দারুণ ভক্ত বনে গিয়েছিল ও বড় ভাইয়ের। মেলিন্দা নিজেও। অবাক হয়ে ও ভাইয়ের কৃতিত্বের কথা ভাবত। কিন্তু পরে তার মনে হলো, চার্লি যেদিন প্রথম নিউইয়র্ক ছেড়ে এসেছে সেদিন থেকে ওর বাবা-মা আস্তে আস্তে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের কাছ থেকে নিজেদের গুটিয়ে ফেলতে শুরু করল। মেলিন্দার মনে হলো চার্লির টাকা-পয়সা তাদের মনে তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। সংসারে টানাটানি সত্ত্বেও বড় ছেলের সেধে দিতে চাওয়া টাকা-পয়সা গ্রহণ করতে সামান্যতম আগ্রহও দেখাননি তারা। ও ভেবেছে, এটা আসলে বাবা-মার অহঙ্কারে আঘাত করেছিল। অভাবে অনটনে দিন কাটাতে কাটাতে তাদের মনে একধরনের হীনন্মন্যতা তৈরি হয়েছিল। তাই ছেলের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিতে পারেনি তারা।

মেলিন্দার ধারণা, আর্থিক অনটনের কারণে দুশ্চিন্তা করতে করতে বাবা-মার জীবনীশক্তি ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাই প্রায় অকালেই মরতে হয়েছিল তাদের।

মেলিন্দা বাস্তববাদী মেয়ে। ভাই অনেকদিন পশ্চিম থেকে ফেরেনি। কোনো যোগাযোগও রাখেনি তাদের সঙ্গে। তাই এর খারাপ দিকটাও ভেবে রেখেছিল সে। চার্লির অনেক টাকা-পয়সা ছিল। অন্তত সেরকমই ভাব দেখাত ও। এখন সে যদি মারা গিয়ে থাকে এবং ওর যদি বউ না-থাকে, তাহলে ওই টাকা-পয়সার উত্তরাধিকারী এখন মেলিন্দা আর বাডই। বাবা-মা মারা যাওয়ায় এখানে তাদের আর কোনো বন্ধন নেই। তাই সে ভাইকে খুঁজতে বেরিয়েছে। ভাইয়ের যদি ভালো-মন্দ কিছু হয়ে যায়, তাহলে তার টাকা-পয়সার কী অবস্থা হয়েছে, সেটা তাকে জানতে হবে। নিজের জন্যে নয়, তার টাকা-পয়সার দরকার চোট বাডের জন্যেই। ওর পড়াশোনার বয়স হয়েছে। মেলিন্দা ছেলেটাকে লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়েছে দেখতে চায়।

জীবনে এই প্রথম পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে এত বড় একটা দেশে পা রেখেছে ও। ওর বিস্ময় বাঁধ মানছে না। একই সঙ্গে অজানা এক আতঙ্কে দুলে উঠছে মন। তবে এর মধ্যেও ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করতে শুরু করেছে সে। পরিকল্পনা করছে বাডও। বিশাল এ-দেশটাকে দেখামাত্র পছন্দ করে ফেলেছে ও। তবে ওর চিন্তার সাথে বোনের চিন্তার দুস্তর ফারাক। ওর পরিকল্পনা বারবার এক জায়গায় মার খেয়ে যাচ্ছে।

‘এখানে সব কিছু ঠিক আছে,’ তিনজনের জন্যে ঠাসাঠাসি হয়ে যাওয়া সিটে যুৎসই হয়ে বসার চেষ্টা করতে করতে বলল সে। ‘কিন্তু একটাই সমস্যা। আমার যদি একটা স্যাডল হর্স থাকত, তাহলে চমৎকার হতো। অবশ্য আমরা যখন চার্লির র‍্যাঞ্চে পৌঁছাব, ওখানে একটা ঘোড়া আর আর স্যাডল পেয়ে যাব নিশ্চয়।’ বোনের দিকে চাইল সে সমর্থন পাওয়ার  আশায়।

কিন্তু ওর মতো আশাবাদী মনে হলো না বোনকে। মেলিন্দা মৃদুস্বরে বলল, ‘বুঝতে পারছি না, চার্লির র‍্যাঞ্চে গিয়ে আমরা ঠিক কী দেখতে পাব।’

‘কিন্তু এখানে রওনা দেয়ার আগে তুমি অনেক কিছু পাওয়ার কথা বলেছিলে,’ নেভাদা স্মরণ করিয়ে দিল  ওকে।

বাকবোর্ড যখন পেনোলোয়া ক্যানিয়নে গিয়ে পড়ল, মেলিন্দার মনে হলো তাদের আসল যাত্রা এখনই শুরু হলো। গত চারদিন ধরে নেভাদা বলে আসছিল, হাইরিভার নামের শহরটায় পৌঁছাতে পারলে তারা আইএক্সএল র‌্যাঞ্চ সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানতে পাবে।

এখন তারা ক্যানিয়নের মাঝখান দিয়ে চলেছে। দু’পাশে খাড়া লাল দেয়াল উঠে গেছে ওপরের দিকে। ঘোড়ার খুর আর বাকবোর্ডের চাকার ঘষায় ধুলো উড়ছে।

আধ ঘণ্টা পরে পেছনে ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল। মিনিট পাঁচেক পরে দুই ঘোড়সওয়ারকে দেখা গেল বাকবোর্ডটাকে ওভারটেক করতে। সিটের মাঝখানে বসেছিল মেলিন্দা। চট করে নেভাদার মুখের দিকে চাইল সে। নেভাদার মুখ শুকিয়ে গেছে। ভাঙা কর্কশ শব্দে টিমহর্সগুলোকে দ্রুত চলতে তাড়া লাগাল লোকটা।

ঘোড়সওয়ার দু’জন দু’পাশ থেকে বাকবোর্ডের কাছ ঘেঁষে এল। দু’জনই তরুণ, কঠিনদর্শন। কাউবয়রা সচরাচর যেধরনের পোশাক পরে, ওদের পরনেও সেধরনের পোশাক। মাথায় চওড়া ব্রীমের চ্যাপ্টা হ্যাট। গলার কাছে ঢিলে করে বাঁধা সিল্কের গলাবন্ধ। গায়ে নীল শার্ট আর ওভারঅল। চামড়ার তৈরি বাদুড়পাখা চ্যাপসে এর প্রায় অর্ধেকটাই ঢাকা। পায়ে উঁচু হিলের বুটজুতো।

এধরনের পোশাক পরা লোক মেলিন্দা আগে দেখেনি। তবে উঁচু হিলের বুটজুতো ওর অপরিচিত নয়। চার্লিকে শেষবার পশ্চিম থেকে বাড়ি ফেরার পর এধরনের বুট পরতে দেখেছে ও। এছাড়া দুই রাইডারের কোমরে বাঁধা কার্তুজভরা বেল্ট। মুখ খোলা হোলস্টার থেকে উঁকি দিচ্ছে পয়েন্ট ফরটি ফাইভ। দু’জনেরই স্যাডলে দুটো কারবাইন।

রাইডাররা হাসছিল। তবে তাদের দু’ জোড়া চঞ্চল চোখ যেন গিলে নিচ্ছিল বাকবোর্ড আর তার যাত্রীদের। বিশেষ করে মেলিন্দার দিকে বারবার চাইছিল ওরা।

ওদের চোখের সামনে সঙ্কুচিত বোধ করছে মেলিন্দা। দু’গালে লালের আভা। তবে সেটা লজ্জা না রাগে বোঝা যাচ্ছে না। অস্বস্তিতে নড়ে চড়ে বসার চেষ্টা করছে ও।

‘আরে! তুমি অত লজ্জা পাচ্ছ কেন, ম্যাম?’ ওদের একজন ভালমানুষের মতো মুখ করে বলল। ‘এখানে তো লজ্জা পাওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি।’

‘আহ্, এসব কী শুরু করলে, জ্যাক!’ বিরক্তি প্রকাশ করল আরেকজন। ‘চলে এসো। অন্ধকার নামার আগে আমাদের হপকিন্স র‌্যাঞ্চে গিয়ে পৌঁছাতে হবে। ভুলে গেছ?’

‘আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও।’ জড়িত স্বরে বলল জ্যাক। মদ খেয়েছে ও। খিক খিক করে হাসল মাতালের হাসি। ‘আমার মনে হয় আমাদের ছোট্ট বোনটির একটা পেলে মন্দ লাগবে না।’ চ্যাপসের পকেট থেকে ছোট্ট একটা বোতল বের করল। বাড়িয়ে ধরল মেলিন্দার দিকে। ‘নাও। এক ঢোক খেয়ে গলা ভিজিয়ে নাও।’

‘না, ধন্যবাদ,’ শুকনো স্বরে ওর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল মেলিন্দা। ‘আ-আমি ওসব খাই না।’

‘অ্যাঁ!’ চমকে ওঠার ভান করল জ্যাক। ‘খাও না? বল কী? আরে, তুমি বুঝতে পারছ না ঠিক কী জিনিসটা  হারাচ্ছ।’ নেভাদার দিকে চাইল। ‘তুমি? তুমিও খাও না নাকি. বুড়ো মিয়া?’

‘ধ-ধন্যবাদ।’ জবাব দিল বুড়ো। ‘হু-হুইস্কির মতো ভালো জিনিস পেলে আমি সচরাচর ন্-না বলি না।’

হাত বাড়িয়ে বোতলটা নিল নেভাদা। হাঁ করে গলায় ঢেলে দিল খানিকটা। তারপর মুখ বিকৃত করে ওগুলো গিলতে গিলতে বোতলটা ফিরিয়ে দিল জ্যাককে।

‘কই, এসো জ্যাক! চলে এসো।’ তার সঙ্গী ফের ডাকল জ্যাককে।

‘অবশ্যই। কিন্তু তার আগে উতাহ্য় এ পর্যন্ত দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকে আরেকটু দেখে নিই। আমার মনে হয় ওর ওই সুন্দর ঠোঁটদুটোতে এমন চমৎকার হুইস্কিটার দু’ ফোঁটা না-পড়লে হুইস্কিটারই অপমান হবে।’

বোতলে চুমুক দিল ও। কয়েক ঢোক খেয়ে মুখ থেকে সরিয়ে নিল ওটা। তারপর ছুড়ে দিল বাকবোর্ডের ওপর। ‘ওখানে রেখে গেলাম, ছোট বোন। এখন হয়তো লজ্জা পাচ্ছ। ঠিক আছে, পরে খেয়ে নিও।’

ঘোড়ার পেটে স্পার দাবাল ও। একধরনের শব্দ করল মুখে। তারপর ঘোড়া ছোটাল সামনের দিকে। ওর সঙ্গীও ওকে অনুসরণ করল। কিছুক্ষণ পরে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল দুই ঘোড়সওয়ার।

‘আমার যদ্দূর মনে পড়ে তুমি একদিন বলেছিলে তুমি ড্রিঙ্ক করো না,’ অভিযোগের ভঙ্গিতে নেভাদার দিকে চাইল মেলিন্দা।

‘আমি আমার শরীরের ক্ষতির কথা ভেবে ড্রিঙ্ক করি না, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু যখন ওয়াইল্ড ওয়ানদের কেউ মুখের কাছে বোতল এনে সাধার নামে খেতে বলে, তখন সেটা না-খেয়ে প্রাণটাই হারানোর ঝুঁকি নিতে চাই না।’

‘মানে? তুমি কি বলতে চাইছ, ওই লোকগুলো আ-আউট ল?’

‘তোমার সাথে সাড়ে সাত ডলার বাজি ধরতে রাজি আছি আমি,’ গম্ভীর স্বরে জানাল নেভাদা।

‘তাহলে তারা আমাদের কিছু না-বলে চলে গেল কেন?’ উত্তেজিত স্বরে জানতে চাইল বাড। ‘তারা তো...’

‘তারা গাধা নয়।...তাছাড়া আমরা এখনো ওদের আওতার বাইরে চলে যাইনি।’ সামনের দিকে তাকাল ও। ‘ইস, সামনে যদি কোথাও একটা শর্টকাট পথ পেতাম, তাহলে ওদের ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে পারতাম।’

‘তার মানে তুমি ভয় পাচ্ছ যে, ওরা আবার ফিরে আসতে পারে?’ জানতে চাইল মেলিন্দা।  ‘কেন, ওদের কি এই ভয় নেই যে, আমরা ওদের চিনে যাব?’

‘আ-আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে তোমার সাথে যদি মূল্যবান কিছু থাকে, তাহলে সেগুলো ভালোভাবে লুকিয়ে রাখো যেন ওরা এলেও খুঁজে বের করতে না-পারে। তোমার টাকা-পয়সা কোথায় রেখেছ?’

‘ওটা,’ একটু ইতস্তত করল মেলিন্দা, লজ্জা পাচ্ছে বলতে। ‘ওটা এখানে।’ কোমরের কাছে এক জায়গায় দেখাল। ‘ওরা হয়তো এখানে খোঁজার কথা নাও ভাবতে পারে।’











কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন