জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

শনিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১১

চড় (গল্প)

বেলা প্রায় দুটো। কাপ্তাই জেটিঘাটের আজমীর বেকারিতে এখন লোকজন বিশেষ নেই। এ-সময়টায় একটু কম থাকারই কথা। নৌকোর নাইয়াগুলো সকালের চা-নাস্তার পর বেলা বারোটা পর্যন্ত বসে বসে আড্ডা মেরেছে; হাসি-ঠাট্টা, হৈ-হুল্লোড় আর খিস্তি খেউড়ে নরক গুলজার করেছে। এখন দুপুরের ভাতটাত খেয়ে নৌকোয় বসে তাস পিটাচ্ছে নয়তো ভোঁসভোঁসিয়ে ঘুম দিচ্ছে।
জেটিঘাটের লেবাররা আড্ডা মারার সময় পায় না। কাপ্তাই লেকে এখন ভরা পানি। কাজের ফুল সীজন। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত গাড়ি লেগে থাকে। ফায়ারউডে, বাঁশে, শনে নয়তো গোলগাছে। হরদম চলছে লোড-আনলোড। দেরি টেরি করলে ড্রাইভাররা প্যাঁ পোঁ জুড়ে দেয়, মাঝিরা এসে দাঁত খিঁচোতে শুরু করে। তারাও তাই কেক-পেটিস-হালুয়া-বাটারবন-নোনতা নয়তো বেলা বিস্কুট দু’হাতে খেয়ে বসতে না-পারার ক্ষতিটা খেয়েই পুষিয়ে নেয়।
মোস্তাকের খুব বাজে একটা অভ্যাস আছে। দিনের বেলা ঘুমোতে পারে না। শুয়েছিল কিছুক্ষণ। ঘুমোতে পারেনি। গরমে ভাঁপা পিঠের মত থকথকে হয়ে শেষমেষ খুব কিছুক্ষণ গালাগালের চোটে গরমের চৌদ্দ গোষ্ঠি উজাড় করে তাড়া খাওয়া মোষের মত নৌকো ছেড়ে হন হন করে বেকারিতে এসে ঢোকে। ডান দিকের টেবিলগুলোর একটায় খালি চেয়ার পেয়ে ধপ করে বসে পড়ে। দু’পা তুলে দেয় চেয়ারের ওপর। নবাবি মেজাজে হুকুম চালায়, ‘এই, এক কাপ চা দে রে...’ 
ক্যাশিয়ার বসে ঢুলছিল। হাঁক শুনে লাল চোখদুটো মেলে চাইল। হাতের কাছে রাখা কলিং বেলের সুইচটা টিপে দিল সজোরে। টু-ইন-ওয়ানে ভারতীয় বাংলা গান বাজছে। ক্যাসেটটা পাল্টে হাসান-হোসেনের জারির ক্যাসেট চাপিয়ে দিল এবার।
গরম চায়ের কাপটা সামনে আসতেই মোস্তাক সোজা হয়ে বসে। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে ভোঁ ভোঁ করে। গরম টরম সব পালিয়েছে। এখন চায়ের বাদামী রং আর দুধ-চিনি-পাতা মেশানো ওভালটিনের তাজা গন্ধটা তাকে চাঙা করে তোলে। পিরিচে না ঢেলে কাপসুদ্ধ ঠোঁটে ছুঁইয়ে লম্বা চুমুক দেয় সে। তারপর শাহী কায়দায় হাঁক ছাড়ল ক্যাশিয়ারের উদ্দেশে, ‘তাহের মিয়া, হিন্দি লাগাও।’
 কোণের দিককার টেবিলে টুপি মাথায় খোঁচা খোঁচা চাপ দাড়িঅলা একটা লোক বসেছিল। মোস্তাকের কথা শুনে হাঁ হাঁ করে উঠল। ডান হাতটা উত্তরে-দক্ষিণে নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘না না, জারিটাই চলুক। হযরত ইমাম হাসান-হোসেনের (র.) জারি। আহা হা হা...’ টুপিসুদ্ধ মাথাটা বারকয়েক নাড়ল সে ডানে বাঁয়ে। ‘...ওরে গুণের ভাই... কে তোরে খাবাইল জহর...’
কদমছাট চুল আর কানের ওপর তুলে কাটা জুলফিঅলা লোকটা খোঁচা-দাড়ির একেবারে বিপরীত দিকের কোণটাতে বসেছিল। গরমের দাপটে আর ওভালটিনের গন্ধঅলা চায়ের মৌতাতে এতক্ষণ নজরে পড়েনি মোস্তাকের। তাছাড়া ওর দিকে পিঠ দিয়ে বসেছিল সে। হঠাৎ বুলেটের মত ছুটে এল যেন অর্ডারটা, ‘আগের সে বাংলা ক্যাসেটটা লাগাও তো, ক্যাশিয়ার।’
অর্ডারটা বেসুরোভাবেই কানের ফুটো গলে ভেতরের নরম পর্দাটায় তীক্ষè একটা ধাক্কা দিল। মোস্তাকও তাই বুলেটপ্র“ফ গলায় বলল, ‘বাসতে বাসতে পর্বত পর্বত... মোহাম্মদ রফির সে গানটা, তাহের মিয়া...’
কদমছাট খেপে গেল। গর্জে উঠল, ‘আমি বলছি বাংলা গান!’
‘আমি বলছি হিন্দি গান। আর আমিই আগে বলেছি।’
তাহের মিয়া চোখ টিপল। ডোরাকাটা পোশাক আর কানের ওপর জুলফি তোলা কদমছাট চুল দেখলে বাচ্চা ছেলেটাও চোখ বুজে বলে দিতে পারে, ইনি...
তাহের মিয়ার চোখ টিপুনি দেখে লোকটার আত্মমর্যাদা চাড়া দিয়ে উঠল এবার। ‘বাঙালি হয়ে বাংলা গান শুনতে চাও না! দেখি কী করে হিন্দি লাগাও!’
মোস্তাক খ্যা খ্যা করে ওঠে, ‘আরে রাখেন মিয়া! অত স্পীচ দিয়েন না। অমন বাহাদুর হোন তো দেশের সবগুলো হিন্দি গানের ক্যাসেট বাজার থেকে তুলে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন দেখি।’
লোকটার গর্জন বন্ধ হয়ে গেল আচমকা খেই হারিয়ে। কথার আগুন মুখ দিয়ে বেরোবার পথ না পেয়ে চোখে গিয়ে জমা হলো। মৃদু হাসল মোস্তাক। ক্ষমতা আর অসহিষ্ণুতার রং আরো অনেক দেখেছে সে।
‘আচ্ছা, তোমায় দেখব।’ লোকটা লাফ দিয়ে উঠল চেয়ার হতে। হাতের ঠেলায় টেবিলটাকে ধাক্কা মেরে কিছুটা সামনে সরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে। টেবিলের ওপর চায়ের খালি কাপটা পিরিচের মধ্যে ঝনাৎ করে ওঠে। আধাভর্তি পানির গ্লাসদুটো টাল সামলাতে না পেরে প্রথমে টেবিলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তারপর গড়াতে গড়াতে ঝনঝনাৎ করে নিচে, একেবারে পাকা মেঝের ওপর। লোকটা তাতে ভ্রƒক্ষেপ মাত্র না করে ক্যাশের সামনে এসে চায়ের দামটা ফেলে দিয়ে আগুনে চোখে মোস্তাককে দেখে নেয় একবার। তারপর হন হন করে বেরিয়ে যায়।
 মোস্তাক বিড়ি ধরায়। লম্বা একটা টান দিয়ে ভোঁস করে এক দলা ধোঁয়া ছেড়ে দেয়। ফ্যানের বাতাসে ঘুরপাক খেতে থাকে ধোঁয়ার দলাটা।
ক্যাশিয়ার খেপে যায়। ‘শালা বানচোতগুলা!’ গালাগাল শুরু করে সে। ‘কতদিন না বলেছি কাস্টমার চা খাওয়ার সাথে সাথে খালি কাপ-পিরিচ আর গেলাস টেবিল থেকে তুলে নেবার জন্যে! দিল তো এখন দু’দুটো গেলাস ভেঙে? রাখ শালাইন, তোদের নামেই তুলব গেলাস ভাঙার জরিমানা।’
বয়গুলো এমনিতেই হাঁ হয়ে গিয়েছিল। ক্যাশিয়ারের গালাগাল শুনে কী করবে ঠাহর করতে না পেরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। একজন এসে তাড়াতাড়ি ভাঙা কাচের টুকরোগুলো কুড়োতে লেগে গেল।
ক্যাশিয়ার এবার মোস্তাকের দিকে চাইল। ‘কাজটা ভাল করলি না, মোস্তাক।’ হাসান-হোসেনের জারির ক্যাসেটটা খুলে নিয়ে হিন্দি গানের ক্যাসেটটা লাগিয়ে দেয় সে। ‘এদের না ঘাটানোই ভাল। ক্ষমতা যখন এদের হাতে, তখন বেঁধে নিয়ে কষে ঠেঙাতেও বাধবে না।’
 মোস্তাক অবজ্ঞার হাসি হাসে। ‘পাতি বাঘ! ডোরাকাটা হলে কী হবে?’
 বেরিয়ে আসে সে। মেজাজটা তেতো হয়ে গেছে। মিথ্যে বলেনি ক্যাশিয়ার।  মেজাজ ঠিক রাখতে পারেনি সে। কদমছাট চুল আর খাটো জুলফির লোকটা খারাপ কিছু বলেনি। বাঙালির বাংলা গানই শোনা উচিত। লোকটা আদতে সে কথাই বলতে চেয়েছে। তবে সমস্যা হলো গিয়ে ওর গলায় ক্ষমতার দাপট দেখা গেছে বলেই মোস্তাকের ভাল লাগেনি। তাই তার চোখা জবাব দিয়েছে সেও। কিন্তু লোকটা সেটা বুঝলেই তো। নাহ, হপ্তাখানেক দেখে শুনে চলতে হবে।
বদল হক সওদাগরের দোকানের দিকে তাকিয়ে দেখে সে। কাঁচা মিষ্টি কুমড়ার মত গোল হয়ে বসে আছে সওদাগর সাহেব। কর্মচারী ছেলেটা ডাল মাপছে কাগজের ঠোঙায়। দু’একজন খদ্দের আছে। নাহ, আড্ডা মারার চান্স নেই। কুমড়োপেটা বোতলমুখো সওদাগরটাকে একদম নাপছন্দ মোস্তাকের। ব্যাটা যেন কোরান-হাদিছ আর মছলা-মছায়েলের জাহাজ। হাতের কাছে মওকামত কাউকে পেলেই চোখ বুজে বিতরণ করতে লেগে যায়। অসহ্য লাগে তখন, আঞ্চলিকতাকে যখন জাতীয় পর্যায়ে ফেলে সোসিওলজির জ্ঞানদান করতে শুরু করে। বক্তৃতার সারমর্ম: চিটাগাইঙ্গা ইজ দ্য বেস্ট অব অল ইন বাংলাদেশ।
সামনের দিকে হাঁটা শুরু করল সে। মদীনা হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল। বাংলা ছবির গান বাজছে ফুল ভল্যুমে। ‘প্রাণ সজনী’র গান। ঢুকে পড়ল সে। অ্যান্ড্রু কিশোরের গাওয়া গানটা খুব ভাল লাগে। ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে..’ সুরের জাল আর কথার মালায় কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ‘লারে লাপ্পা’র কড়া থাপ্পড়ের জ্বালা থেকে নি®কৃতি পাওয়া যায়।
খালি মুখে গান শোনা জমে না। পকেটের স্বাস্থ্যও আজ লাকড়ি বেচা পয়সার বদৌলতে মোটামুটি তেলতেলে। সুতরাং বয়টা কাছে এসে দাঁড়াতে এক প্লেট গরম পেঁয়াজুর অর্ডার দেয় মোস্তাক।
 পেঁয়াজু চিবুতে চিবুতে কিছুক্ষণ আগে আজমীর বেকারিতে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা  মনে মনে ঝালাতে শুরু করে। আজকের দিনটাই শালার মাটি! সকাল থেকে শুরু হয়ে গেছে ঝগড়াঝাটি। মেট মাঝির সাথে লাকড়িবেচা পয়সা নিয়ে হয়ে গেছে এক চোট। নৌকোর গলুই-পাছা পুরো করে  কড়–ই আর ভুরা গাছের লাকড়ি এনেছিল তারা খেপ নিয়ে আসার সময়। এক নজর দেখলেই বলে দেয়া যায় কম করে হলেও শ’তিনেক টাকার লাকড়ি তো হবেই। ধড়িবাজ শালাটা কোন ফাঁকে মির্জির সাথে যোগসাজস করে এসে বলে কিনা মাত্র দুশ’ টাকা বেচা গেছে লাকড়ি। মির্জি হারামখোরটাও তাই সাক্ষ্য দিচ্ছে। দেবেই তো। চোরে চোরে খালাতো ভাই যখন!
তা বেশ। দুশ’ টাকাই না হয় হলো। তবু তো মেট মাঝির দু’ভাগ বাদ দিয়ে নাইয়া তিনজনের ভাগে তেত্রিশ টাকা করে পড়ে। তিন টাকাও বাদ যাক। তিরিশ টাকা। আর শালা কিনা দিতে চাচ্ছে মাত্র বিশ টাকা করে। হলো এক চোট।
কী যে করবে শালা অত টাকা দিয়ে! লাকড়িবেচা পয়সা, বাজার খরচা থেকে মারা পয়সা, নাইয়ার বেতন থেকে ছুতো নাতায় কেটে রাখা পয়সাÑমাসে না হলেও পাঁচ-ছয় হাজার করে বানাচ্ছে। কিন্তু করছেটা কী? কই, নিজে তো এতদিনেও পারল না একটা নৌকোর মালিক হতে। মদ, জুয়া আর ‘ভাই’এর পেছনেই তো দিচ্ছে সব। ভাই! এই ‘ভাই’এর জাতটাকে একদম দেখতে পারে না মোস্তাক। রং আর চেহারা দেখে মায়া টায়া লাগলেও পাছা দেখে লাত্থি মারতে ইচ্ছে করে। শালা বেজম্মারা! মোটা একটা গাল ঝেড়ে দেয় ও থুতুর দলার মত।
মিলিটারিটা কী করতে পারে? ওপারেই তো ক্যাম্প। ক্যাম্পে গিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা টরোয়ানা নিয়ে আসবে নাকি?
‘মোস্তাক ভাই।’
 পেছনে ফিরে দেখে ও। হারু মাঝির ভাই। মায়ের পেটের নয়, মুখবোলা। হাতে ঘড়ি। গায়ের টেট্রনের শার্টটা চিনতে পারে সে। হারু মাঝির। একটু বড় হলেও মানিয়েছে বেশ। মাসদুয়েক আগে বানিয়েছিল ওটা হারু মাঝি ড্রেস পার্ক থেকে। মোস্তাকসহ পছন্দ করেছিল পিসটা। ঘড়িটাও নিশ্চয় তার। শালাটার আক্কেল আর হলো না।  কত ঘড়ি, শার্ট আর দামী দামী লুঙ্গি নিয়ে যে পালাল এই ভাইয়ের গোষ্ঠিগুলো! আক্কেল হবে কী? বউ-ছেলেমেয়ে থাকলেই তো! থাকবে কী করে? তিরিশ পেরিয়েছে কবে, শালা আজতক বিয়েই করেনি। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা এই ভাই নিয়েই তো আছে।
‘কী?’ মোস্তাক কড়া চোখে চায়।
‘না, এমনি।’ কাছে এসে বসে ছেলেটা। ‘চা খাওয়াও না এক কাপ।’ মিঠে হাসির ঢল ওর সারা মুখে।
মোস্তাকের ইচ্ছে হয় কষে দুটো চড় লাগায় ছেলেটার দু’গালে। কিন্তু থেমে যায়। কী লাভ? বরং হারু মাঝির সাথে শত্র“তা শুরু হবে শুধু শুধু। আর ছেলেটারই বা দোষ কী? সে তো আর মার পেট থেকে শিখে আসেনি এসব। মারতে হয় তো...
 ছেলেটার চেহারা সত্যিই মায়াবী। মায়াই হয় মোস্তাকের। র্নিষ্পাপ দুই চোখে অদ্ভুত সারল্য। এক কাপ চা আর চারটা পেঁয়াজুর অর্ডার দিয়ে দেয় সে।
খুশি খুশি মুখে মোস্তাকের দিকে তাকায় ছেলেটা। ভাবতেই পারেনি তার জন্যে সত্যি সত্যিই চা আর পেঁয়াজুর অর্ডার দেবে মোস্তাক। মোস্তাককে নিয়ে তার অনেক কৌতূহল আছে। ভাব জমাতে চেয়েছে আরো আগে। কিন্তু পাত্তা পায়নি।
 সে কাপ্তাই এসেছে মাত্র মাস কয়েক। এরই মধ্যে অনেক রকম মানুষ দেখেছে। গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে চাওয়া মানুষের অভাব নেই এখানে। যখন তখন মিষ্টি খাওয়াতে চায়, সিনেমায় নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম এই লোকটা। সবার চেয়ে কেমন যেন আলাদা। হারু মাঝির কাছে শুনেছে, মোস্তাক ভাই ম্যাট্রিক না কী যেন পাস। সে ভেবে বুঝে উঠতে পারে না, এতদূর লেখাপড়া করলে লোকটা নৌকোয় চাকরি করে কেন? কিন্তু মোস্তাককেও জিজ্ঞেস করার সাহস হয়ে ওঠেনি তার। কেমন যেন রাগী রাগী লোকটা।
 পেঁয়াজু চিবুতে চিবুতে বাইরে তাকায় ছেলেটা। বাঁশের গাড়ি উঠছে নামার চর থেকে ফার্স্ট গিয়ারে গোঁ গোঁ করতে করতে। শুক্কুর চেয়ারম্যানের দোকানের সামনে ভীড় করে দাঁড়িয়েছে কয়েকজন। লালমুখো চারজন বিদেশিকে দেখা গেল ভীড় ঠেলে বেরিয়ে আসছে।
বিদেশি দেখলে তার খুব মজা লাগে। পেঁয়াজু খেতে খেতে মোস্তাকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেদিকে। খুশি খুশি মুখে বলে, ‘ইস, কী সাদা! টুরিচ, না?’
 মোস্তাক হাসিমুখে মাথা নাড়ে।
বিদেশি চারজন হোটেলে এসে ঢোকে। দু’জন মেম। মেম দু’জন ক্যাশের সামনে দাঁড়ায়। সায়েব দু’জন পেছনে।
‘এনি কোল্ড?’ সুরেলা গলায় একজন মেম প্রশ্ন করে।
‘কোকাকোলা অর ফান্টা অর সেভেন আপ?’ অন্যজন সুর মেলায়।
কোকাকোলার নাম শুনে ক্যাশিয়ারের হা করা ঠোঁটদুটো জোড়া লাগে।
‘অ্যাঁ..হ্যাঁ.. হ্যাঁ..জী..জী!’ রীতিমত ব্যস্ত হয়ে পড়ে ক্যাশিয়ার।
‘হ্যাভন্ট?’
‘ইয়েস। দেয়ার’স আ রেফ্রিজারেটর ইন দ্য কর্নার।’ ক্যাশিয়ারের দিকে চেয়ে হাসে একজন সায়েব। ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলে, ‘ফ্রিজ ঠেকে চারটা কোক ডিন তো।’
‘ওহ, থ্যাঙ্কস!’ মেম দু’জন সায়েবদের দিকে চায়। চারজনে ফ্রিজের কাছাকাছি টেবিলটা দখল করে। পরস্পর মুখোমুখি বসে খুশিতে ছলকে ওঠে।
ক্যাশিয়ারের হাঁকাহাঁকি, বেল টেপাটেপি; বয়-বেয়ারাদের ছোটাছুটি। নতুন ন্যাপকিন নিয়ে এসে টেবিল মোছা, গ্লাস মেজে পরিষ্কার করা, ফ্রিজ খোলাÑহুলুস্থুল ব্যাপার।
ততক্ষণে  ফের ঘের দেয়া হয়ে গেছে চারদিকে। জোড়ায় জোড়ায় উৎসুক চোখ মেমদুটোকে কাঠঠোকরার মত ঠুকরে খাচ্ছে। মেম দু’জন উসখুস করে।
‘ওহ, হাউ ননসেন্স দ্য গেদারিং!’ একজনের পাতলা লাল ঠোঁটদুটো থেকে বিরক্তি ঝরে পড়ে এক রাশ।
‘এই যে, আপনারা একটু ভীড়টা পাটলা করেন। প্লি-জ!’ বাংলা জানা সায়েবটার গলায় অনুনয়।
‘অ..হ্যাঁ হ্যাঁ..ইয়েচ ছার। উই..উই..অ্যাই, তোমরা সব সরে দাঁড়াও। সরে দাঁড়াও!’ জেটির কেরানী সাব কৃতার্থ হয়ে যান। তিনিও আছেন ভীড়ে। কথাটা বলার সময় তার দিকেও একবার চেয়েছে সায়েব। সুতরাং বিশিষ্ট ভদ্রলোক হিসেবে ভীড় সরানোর দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নেন তিনি।। দু’একজনকে সরিয়ে দিতে যান। ধাক্কা টাক্কাও মারেন। তারপর সায়েবদের কাছে এসে আলাপ জমাতে চান। ‘ছার, ইউ..মানে..ইউ ট্রাভেলার?’
‘খেন? ফর হোয়াই?’ গায়েপড়া ভাব পছন্দ হয় না সায়েবের। সরাসরি বিরক্তি প্রকাশ করে। ‘আপনার টাটে খী প্রয়োজন? আর য়ু আ গাইড? স্যরি, উই ডোন্ট নিড এনি গাইড।’
‘জী.. হোয়াট? মানে হোয়াট ইউ চে ছার?’ কেরানি সাব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান।
‘আমি বলসি, সরে যান। ভীড় করবেন না। উই আর নট দ্য বীস্টস অভ জু। উই আর হিউমেন জাস্ট লাইক য়ু।’
ভীড় পাতলা হতে শুরু করে। কেরানী সাব হতাশ হয়ে আরেকটা চেয়ারে বসে চায়ের অর্ডার দেন। মেমগুলো কাচভাঙা হাসি হাসে। দেশি ভাষায় একচোট বকে নেয় একটা মেম।
মোস্তাক মৃদু হাসে। শালারা! লাল চামড়া দেখলে যেন সবার মাথা খারাপ হয়ে যায়। কী শিক্ষিত, কী চাষা। হাজার হলেও এক সময়ের প্রভুদের জাত তো! পুরাতন ভৃত্যদের কাছে ইজ্জত তো পাবেই।
হারু মাঝির ভাইটা খুব হাসছে লোকগুলোর সুড় সুড় করে পালানো দেখে। হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে গড়িয়ে পড়তে যায়। মোস্তাকও হাসে। ছেলেটা মোটামুটি মিশুক বটে।
‘কী রে মোস্তাইক্যা, পাইয়জ্জে না উ¹া?’ বলতে বলতে একজন ঢোকে। ‘ঠিগাছে, চালা। তয় আঁরার মিক্কাঅ এককানা চাইছ টাইছ...’
ফিশারীর লেবার, গালফুলা জামাইল্যা। ফোলা গালের ওপর কুঁতকুঁতে চোখদুটোতে সারাক্ষণ শয়তানি হাসি খেলছে।
‘কী হদ্দে?’ মোস্তাকের মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে যায়। স্থির চোখে তাকায় লোকটার দিকে। লোকটার পিঙ্গল দু’ চোখে বিকৃত রহস্যের থিকথিকে কাদা। মণিদুটো চকচক করছে সাপের পিঠের মত। লোকটা কাপ্তাই জেটিঘাটের আরেক নোংরা হোমো।
 মোস্তাক ঘেমে ওঠে। বোশেখ মাসের গুমোট, হিন্দি-বাংলার ঝগড়া, মেট মাঝির শয়তানি, বদল হক সওদাগরের উন্নাসিকতা, সায়েবটার ধমক আর মেমদুটোর মন্তব্য ধীরে ধীরে ওর মগজে যেন  কেমন এক ধরনের উত্তাপ জমাতে শুরু করেছিল।
‘কী হইয়ুম আর? আঁরার হতাঅ মনত টনত রাখিছ।’ চোখ টিপে হারু মাঝির ভাইয়ের দিকে চেয়ে রসালো ইঙ্গিত করে লোকটা। দুই কানের গোড়া পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয় ফোলা গালের ওপর দিয়ে ময়লা দেঁতো হাসিটাকে। মোস্তাক উঠে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে লোকটার সামনে এগিয়ে যায়। ভাল করে চেয়ে দেখে। তারপর হঠাৎ দাড়টানা কড়াপড়া হাতে ঠাস করে প্রচণ্ড এক চড় বসিয়ে দিল গালফোলা, কুঁতকুঁতেচোখা লোকটার ডান গালে।








কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন