জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১১

বেনামী বন্দর (কবিতা)

পাঁচজন অন্ধ বলে ওঠে, বাহ্, কী সুন্দর!’
পাঁচজন বধির বলে ওঠে, ‘চমৎকার, দারুণ বলেছ!’
পাঁচজন ল্যাঙড়া নেচে ওঠে, ‘হুররে হো!’
একজন রাজাকার ঊর্ধ্ববাহু-নারায়ে তকবীর...

একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী বিছমিল্লাহ বলতে বলতে
আচমকা আর্তনাদ করে ওঠে, ‘দেখো, ওরা বেচে ফেলল...
পাঁচ হাজার চামচিকে ঝটপট করতে করতে
দশ হাজার ছুঁচো হুটোপুটি খেতে খেতে
আলোর তীব্র ঝলকানি থেকে চোখ বাঁচাতে বাঁচাতে
অন্ধকারে লুকোতে লুকোতে বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বেচে ফেলল...’
শুনে বুড়ো কবি দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে মুচকি হেসে
অতঃপর ধ্যানমগ্ন হলেন
আর ঝাঁকড়া চুলের যুবক কবি, যার একহাতে শ্যামা
অন্য হাতে মোহাম্মদ, চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে আরে
ওরা মোহাম্মদকে কোথায় নিয়ে চলল?’

একটি টোবাকো পাইপ সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়তে পড়তে
নিভে গেল
একজন লুইপা’ এবং একজন কা‎হ্নপা’
আচমকা নিজেদের নাম ভুলে গেল
একদল নিষাদ তাদের জলাভূমি আর ঝোপঝাড় ফেলে
মরুভূমি অভিমুখে প্রাণপণ দৌড় লাগাল।

পাঁচজন অন্ধ বলে ওঠে, বাহ্, সুন্দর তো!’
পাঁচজন বধির বলে ওঠে, ‘চমৎকার, আবার বলুন!’
পাঁচজন ল্যাঙড়া ধেই ধেই নাচতে থাকে, ‘হুররে হো!’
একজন রাজাকার ঊর্ধ্ববাহু-আল্লাহো আকবর...

স্তব্ধতার স্থিরচিত্র (কবিতা)


অতঃপর এক ফোঁটা স্তব্ধতা নেমে এসে
অকস্মাৎ বিস্ফোরিত হলো
আমি হিরোসিমার কথা ভাবলাম
নাগাসাকির কথা ভাবলাম
এখানে এতক্ষণ মানুষেরা কথা বলছিল
পাখিরা ডানা ঝাড়ছিল
এবং এখানে এখন সূর্য টুকরো টুকরো হয়ে
গলে যাচ্ছে কাচের মতোন।

এখানে এখন জন্ম ও পুনর্জন্মের মধ্যবর্তী
অনিশ্চিত অন্ধকার
ত্রিকালজ্ঞ ঋষির সঙ্গোপন অন্ধকার
এবং আমার চেতনায় ‘চরাচর’ নামক শব্দটি
যেরকম বিশালতায় ধরা দেয়, সেরকম
বিশালকায় মোষের মতো গর্জমান স্তব্ধতা
এরকম স্তব্ধতা কি ডুবনোন্মুখ চাঁদের সর্বশেষ বিন্দু
ফুল ঝরে পড়ার শেষতম মুহূর্ত
এরকম স্তব্ধতা তারার পাথর এবং
বৃরে পতনোন্মুখ হলুদ পাতা নাকি
এবং এরকম স্তব্ধতা কি চন্দ্রঘোনার নীল পাহাড়ের
অন্তরঙ্গ
আমাদের বহিরঙ্গ তার স্থিরচিত্রে
ভিন্নতায় ভিন্ন রূপায়নে।

অকস্মাৎ স্তব্ধতার পাথর বেয়ে
এক ফোঁটা অন্ধকার নেমে এসে বিস্ফোরিত হলো
প্রস্তর মূর্তির মুখে চোখের নরম আলো
বিস্ফোরিত হলো
আমি হিরোসিমার কথা ভাবলাম
নাগাসাকির কথা ভাবলাম
সেখানে তখন সূর্য টুকরো টুকরো হয়ে
গলে যাচ্ছিল।


বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১১

গল্প (কবিতা)


প্রথম গল্পই যদি মিথ্যে হয়
দ্বিতীয় গল্পের সত্য খোঁজে না মানুষ।

প্রথম গল্পের মিথ্যে আজীবন সত্য হলে
দ্বিতীয় গল্পের সত্য বোঝে না মানুষ।

গল্পের দ্বিতীয় নেই, অদ্বিতীয় জীবনের
একটি মাত্র গল্পে পরিশেষ।

সহস্র গল্পের শেষেও গল্পের সমাপ্তি নেই
জীবনের গল্প মানে হইল না শেষ

চন্দ্রাহত চোখ থেকে  হলুদ পাতার ভস্ম
ঝাড়তে ঝাড়তে বলল সে,
গল্প সত্য নয়।

ঘাসের ফুলের মত ফুটতে ফুটতে বলি আমি,
গল্পের মিথ্যে মানেই
মিথ্যে গল্প নয়।


রবিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১১

খাট


পূর্বপুরুষ তার খাট ছেড়ে চলে গেছে তিনশ' বছর
খাটখানি রয়ে গেছে. বয়সের সাথে সাথে বেড়েছে কদর
প্রাচীনত্ব গায়ে মেখে দিনে দিনে ঋদ্ধতায হয়েছে প্রবীণ
বনেদিপনার খুব জ্বলজ্বলে ভাঁজ এঁকে কপালে কঠিন
পড়ে আছে বড় ঘরে, অনড় আসন পেতে পুরুষানুক্রমে
মহান বটের মতো সন্ন্যাসীর চেয়ে বড় গম্ভীর আশ্রমে।....

বাবার প্রস্থান শেষে আমি তার পরিত্যক্ত মঞ্চের নায়ক
দৈনিক ক্লান্তির ভার এক পাশে ছুঁড়ে ফেলে আরামদায়ক
পুরোটা রাত্রির ঘেরে শুয়ে থাকি সুনিশ্চিত অর্ধখাটেশ্বর
বাকিটা প্রিয়ার জন্যে, যার বুকে ন্যস্ত রেখে পেৌরুষের ভর
ভারমুক্ত আমি খুব; ঘুমুই তৃপ্তির ঘুম খান্দানি খাটের
শতাব্দীপ্রাচীন বুকে অবিকল ভূমিকায় সুখি সম্রাটের।.

সাম্রাজ্যের হস্তান্তর যুগে যুগে ঘটে যায় অমোঘ শাসনে
ইতিহাস নির্লিপ্ততা বুকে সেঁটে বসে থাকে নিজের আসনে
চুপচাপ; নির্বিকার কালের পুতুল নাচে বৈষ্ণবী মুদ্রায
‌'
অনিত্য অনিত্য' বলে বোল তোলে বাঁয়া-তবলায়
মধ্যরাতে শ্রোতাদের নিদ্রামগ্ন চোখে তবু জীবন যাপন
বনেদি কাঠের খাট দৈনন্দিন আয়োজনে একান্ত আপন

পূর্ব পুরুষ তার খাট ছেড়ে চলে গেছে তিনশ' বছর
খাটখানি পড়ে আছে প্রাচীন ভিটের মতো অজর, অনড়
বাবার প্রস্থান শেষে আমি তার পরিত্যক্ত মঞ্চের নাযক
বনেদি খাটের নামে প্রত্যাশায় মন্ত্রমুগ্ধ স্মৃতির গায়ক
উঠোনে ছড়াই বীজ, একদিন চারা হবে বিশাল পল্লব
পশ্চিমের নদী হতে শেষ রাতে ভেসে আসে ক্ষয়ের কল্লোল

বুধবার, ২ নভেম্বর, ২০১১

তোমার চলার পথ (কিশোর কবিতা)


তোমাকে দেখেই যদি পাখিরা তাদের গান থামিয়ে
দিতে চায় দিক তবে, তুমি কিছু বোলো না তাদের
ফুলেরা পাপড়ি বুজে হাসিমুখ নেয় যদি নামিয়ে
নিক তারা, কী আছে বলার তাতে? তারাদের
আসরে না-ই বা গেলে
চাঁদের প্রদীপ জ্বেলে
আকাশ অন্ধকারে তোমার চলার পথ আলোকিত না যদি করে
তুমি থেমে যেয়ো না তো--পাহাড়ের কাছে যাও, জেনে  নাও
হাজার বছর ধরে নিজের মতন করে নিজেকে বাঁচাতে হয় কী করে
কীভাবে গাছের মতো মাটিকে আপন ভেবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় শিকড়ে?

তুমি গান গেয়ে যাও, ঝরনা ঘুমিয়ে যদি
থাকে থাক--ক্ষতি কী তাতে?
নদীরা নীরবে বয়ে গেলে যাক
মায়াবী রাতে
ঘুমের গহীনে এসে মোহিনী স্বপ্ন বীণা না-ই বা বাজাক
সোনালি রোদের রেখা যদি না ফোটেও কোনো কালো প্রভাতে
কী হবে তাতে?
তোমাকে তো যেতে হবে চেনার সীমানা ছেড়ে
অচেনার অঙ্গনে অসীম রাতে।

হাজার রজনী ধরে বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে
পথ হাঁটে একাকিনী শাহেরজাদী
গল্প ফুরিয়ে গেলে স্বপ্ন হারিয়ে যাবে
জীবন যে হবে তামাদি
আরবের মরু ছেড়ে ইরাক ইরান আর ভূমধ্য সাগরের তীরে
নীলের মোহনা হতে মিসিসিপি আমাজান ইয়াংসি যমুনার চরে
পৃথিবীর সমস্ত মহাদেশ ঘিরে
হাঁটছে শাহেরজাদী জীবনকে ভালোবেসে, তার মতো তুমি
তুমিও এগিয়ে চলো তোমার চলার পথে
হে পথিক জীবনবাদী।

বৃষ্টি ঝরুক (কিশোর কবিতা)


বৃষ্টি ঝরুক বৃষ্টি ঝরুক
এবার তবে বৃষ্টি ঝরুক
মাথার ওপর গুমোট মেঘের
জমাট কঠিন পাহাড় নড়–ক
পায়ের নিচে পাথর জমির
খটখটে বুক ঘাসে ভরুক
ঝরঝরিয়ে বৃষ্টি ঝরুক।


বৃষ্টি নামুক বৃষ্টি নামুক
ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি নামুক
পুবের হাওয়া দিক না দোলা
কালবোশেখির ঝাপ্টা থামুক
আকাশ হিমেল মেঘে ছেয়ে
তাল-সুপুরির পাতা বেয়ে
বাঁশবাগানে পাটের ক্ষেতে
অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামুক
গুমোট মেঘের পাহাড় ঘামুক
আকাশ বেয়ে ঝরনা নামুক।


‘লু’ সাহারা বইছে করাল
জিহ্বা মেলে, নেই যে আড়াল
শাল-পিয়ালের সবুজ বনে
দলকলমির আস্তরণে
নেই ঢাকা মাঠ পুকুর নদী
ন্যাঙটো উদোম সমস্ত দেশ
হায় রে মাটির ঝলসানো বুক
পলিমাটির দেশে অসুখ
পুড়ছে মাটি-মানুষের বুক
এই আগুনের  নেই কী রে শেষ!


বৃষ্টি আসুক বৃষ্টি আসুক
বৃষ্টিতে মন-মাটি ভাসুক
কদম-কেয়ার পাপড়ি হাসুক
বৃষ্টি আসুক বৃষ্টি আসুক;
বৃষ্টিতে বান-বন্যা উঠুক
সাত সাগরের প্লাবন ছুটুক
নুহ নবীর কিস্তি বেয়ে
চিরকালের কোরাস গেয়ে
মানুষ যাবে নতুন চরের
সন্ধানে, আহ বৃষ্টি ঝরুক
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ঝরুক।









সোমবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১১

শাদা শাড়ি ......ঘুম (কবিতা)

শাদা শাড়ি ভালোবাসে মেঘের মেয়েরা!


না-উত্তুর না-দখিনা বাতাস খুব গায়ে মেখে
আকাশের নীল বনে আঁচল ওড়ায়
বরষায় ওরা খুব কেঁদেছিল তুমুল আবেগে
পৃথিবী ভাসিয়েছিল
মেঘেরা কাঁদলে হাসে পৃথিবীর কাশবন
সবুজ যৌবন ফুল মাতাল বাতাস।
...নেপথ্যে ঝঙ্কার ওঠে বৈরাগীর খঞ্জনীতে
বেহাগ রাগিনী
যাহা শাদা তাহা সত্য, যাহা সত্য তাহা শাদা...
বিভ্রান্তির মেঘ
শাদা শাড়ি পরে ওড়ে আকাশের নীলে।


তুমুল তারুণ্য আর হিসেবি যৌবন খোঁজে
মেঘের সাতরঙ
মুহূর্তের বর্ণচ্ছটা অমোঘ হিসেবে লেখে
সচিত্র জীবন
শরতের শাদা মেঘ সারি বেঁধে উড়ে যায়
উত্তরের পথে
সেখানে শীতল ঘরে হিমায়িত ঘুম...
পেছনে আকাশ মাটি শীত গ্রীষ্ম বসন্ত বাহার
চক্রাবর্ত শাদা শাড়ি...ঘুম।

রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১১

মায়াবী দিনের খাতা (কিশোর কবিতা)

শুকতারা উঠে বলল, 'হে রাত শোনো
তোমার ময়লা চাদর গুটিয়ে নাও
সোনালি সূর্য ফোটার সময় হলো
এইবার তুমি চলে যাও, চলে যাও।'


'চলে যাও তুমি, উঠুক পাখিরা জেগে
কই গো পাখিরা, এখনো ভাঙেনি ঘুম?
গান গেয়ে ওঠো; পুবালি বাতাস এসো
ফুলকলিদের গালে এঁকে দাও চুম।'


'চুম্বনে শিহরিত হোক বনলতা
পুলকে কাঁপুক ঘাসের মিহিন পাতা
জাগুক নদীতে ঢেউয়ের লুটোপুটি
পৃথিবী মেলুক মায়াবী দিনের খাতা।'

'পৃথিবী মেলবে মায়াবী দিনের খাতা,'
বলল পাখিরা। 'যাও রাত সরে যাও।'
সায় দিল তাতে পুবালি বাতাস, নদী
'নাও রাত, তুমি চাদর গুটিয়ে নাও।'


বনলতা দুলে উঠল, ঘাসের মুখে
ফুটল ভোরের শেফালী হাসির কণা
বাইরে বেরোল আলোকের ছেলেমেয়ে
বলে, 'রাত গেল, আর ঘরে থাকব না।'

যে তুমি কিশোর (কিশোর কবিতা)

মেঘনা পাড়ের উদাসী বটের ছায়ায়
যে তুমি বাজাও বাঁশিতে গহীন সুর
সে তুমি জান না কেমন মোহিনী মায়ায়
হাতের মুঠোয় ভরেছ সারা দুপুর;
যে তুমি নিজেকে উজাড় করেছ
মাঠে প্রান্তরে  ছড়িয়ে পড়েছ
মুখরিত করে  বাতাসের গতি
পরিয়ে পায়ে নুপুর;
সেই সে নুপুর নিক্কণে বাজে নদী ও সমুদ্দুর।

 যে তুমি বাজাও নিজেকে হারিয়ে বাঁশিতে আপন সুর
 মেঘনা পাড়ের উদাস দুপুরে মায়াবী মাঠের ছেলে
 তোমার মন কি ঘরহারা এক ব্যথিত চিলের দূর
ছায়ার মতন  নদী মাঠ ছেড়ে দিগন্তে পাখা মেলে!
তুমি  কি জান না পায়ের তলার
মাটি সরে যায় ঘোলাটে গলার
গর্জন  এসে তোমাকে নিঠুর দৈত্যের মত গেলে
তবু কি তুমি সে বাঁশিটি বাজাবে মায়াবী মাঠের ছেলে?

 তোমার বাঁশির সুরে কেঁপে ওঠে নদী ও সমুদ্দুর
 তোমার বাঁশির সাথে সাথে কাঁদে উদাস সারা দুপুর
 তোমার সুরেরা ধোঁয়ার মতন ছুঁতে চায় মেঘপুর--
জান কি তা কতদূর?

 যে তুৃমি কিশোর সে বাঁশি বাজাও
মুক্তো মণির সোহাগে সাজাও
সুরের রঙিন পাপড়ি সে তুমি
যাবে বলো কতদূর?
 তোমার ঠিকানা তুমি কি জান ওই শূন্যের মত দূর?

পিতৃত্ব (রম্য)



Avcwb wb‡R‡K AgiZ¡ `vb Kivi R‡b¨ mš—v‡bi Rb¥ †`b| GUv Avgvi K_v bq, hv‡`i Kíbvkw³ Lye cÖLi Zv‡`i, A_©vr wKbv Kwe‡`i| Avgvi wb‡Ri K_v ej‡Z †M‡j Avwg Aek¨B ¯^xKvi Kie †h, weavZvi Kv‡Q Avwg mš—vb cÖv_©bv K‡iwQjvg| KviY Avwg Ggb KvD‡K †P‡qwQjvg, †h Avgvi cvwievwiK bvgUv Pvjy ivL‡e| my‡Li welq, weavZv Avgvi cÖv_©bv c~Y© K‡i‡Qb| d‡j Avwg GLb cuvP-cuvPwU mš—v‡bi Mwe©Z wcZv| wKš‘ GLb Avgvi GI ¯^xKvi Ki‡Z wØav †bB †h, Zv‡`i cÖwZ GKwU wbR¯^ bvg Luy‡R †bevi Ges Zviv †hb Kv‡iv mv‡_ cwiwPZ nIqvi mgq wb‡R‡`i wcZ…cyi“‡li bvg e¨envi bv-K‡i, †m-K_v e‡j †`qvi mgq n‡q †M‡Q|
AgiZv? nvn&! eis GLb †h Avgvi cuvP-cuvPwU mš—vb, Avgvi GKvš— Kvgbv, Avgvi g„Zz¨i Av‡MB †hb Zv‡`i me¸‡jvB Avgvi Ni †_‡K `~i n‡q hvq| bv, †Kej AgiZvi R‡b¨B Avwg Ges ¯¿x fv‡jv‡e‡m GiKg †bvsiv Kvco‡Pvco civ Aweivg nƇMv‡ji Drm m„wó KwiwbÑwKsev GI Avgiv fvwewb †h, Zv‡`i GKRb †Pqv‡i e‡m mvg‡bi w`‡K Zvi cv †V‡j evwo‡q †`‡e Ges Av‡iKRb Zv‡Z GKRb cÖ_g †kªYxi AwfhvÎxi gZ c~‡Y©v`¨‡g Suvwc‡q co‡eÑGiKg `„k¨ †`LvUv `vi“Y gRvi e¨vcvi n‡e|
GKw`b, ZvB Avwg wR‡Ám Kijvg, ÔIiKg KiQ †Kb?Õ
 †m, †h wKbv †Pqv‡i Dcweó, D‡ëv Avgv‡K cÖkœ K‡i emj, ÔKxiKg KiwQ?Õ
Ô†Zvgvi cv `y‡Uv mvg‡bi w`‡K †V‡j w`”Q!Õ
Ôevev,Õ †Pqv‡i Dcweó Reve w`j| ÔAvwg †V‡j w`w”Q bv †Zv| Avgvi cv `y‡UvB mvg‡bi w`‡K GwM‡q hv‡”Q|Õ
wKsev Avwg Ges Avgvi ¯¿x G R‡b¨I mš—vb wbBwb †h, Zviv G‡K A‡b¨i †cQ‡b mwPrKv‡i QyU‡Z QyU‡Z Nigq `vcv`vwc K‡i †eov‡e Ges GK mgq Avgv‡K wM‡q wR‡Ám Ki‡Z n‡e, Ômgm¨vUv Kx‡mi?ÕÑGes Avgvi Kb¨vi GiKg cÖkœ ïb‡Z n‡e, ÔI Avgvi iƒ‡g Xy‡K Avgv‡K cv †`Lv‡”Q †Kb?Õ
ÔZvB †Zv!Õ Avgv‡K Zvi m‡½ GKgZ n‡Z n‡e Ges wcZ…myjf cÖÁv cÖ`k©b K‡i ej‡Z n‡e, ÔZv Zzwg †Zvgvi iƒ‡gi `iRv AvU‡K w`‡jB cvi...Õ
ÔZvn‡j I Kx Ki‡Q Avwg †`Le Kx K‡i?ÑGiKg cÖ‡kœi R‡b¨I ˆZwi _vK‡Z n‡e|
Z‡e Avcwb hw` g‡b K‡ib †h, GiKg wKQy msjvc Qvov `ywbqv Pj‡ZB cv‡i bv, Zvn‡j Avwg Avcbv‡K mvb‡›`B ev”PvKv”Pv‡`i ˆZwi m¤¢ve¨ me iK‡gi SzUSv‡gjvi K_v fy‡j †h‡Z civgk© †`e Ges GKSuvK W¨v‡dvwWj dzU‡Z †`Lvi gZ Drdzj­ wP‡Ë Zv‡`i AvMg‡bi A‡c¶v Ki‡Z DrmvwnZ Kie|
 Avm‡j Avgvi Ges Avgvi ¯¿xi mš—vb Drcv`‡bi e¨vcviUv n‡jv, †b‡cvwjqv‡bi ivwkqv Avµg‡Yi gZ| GKUv mgq ch©š— GUv Lye `vi“Y e¨vcvi wQj| wKš‘ Gici †_‡K †b‡cvwjqv‡bi gZ Avgvi g‡bI wb‡Ri eyw×gËv m¤ú‡K© m‡›`n RvM‡Z ïi“ Kij|
Avgvi cÖ_g Kb¨vmš—v‡bi eqm hLb AvVv‡iv gvm, ZLb †_‡KB Zvi KvÊ-KviLvbv †`‡L Avgvi m‡›`n‡eva GK`g e×gyj n‡q `uvovj| hZevi Avwg Zvi K‡¶ †hZvg, †`L‡Z †cZvg, †m Zvi weQvbvq Zvi Pvicv‡k ivLv c­vw÷‡Ki †Ljbv¸‡jv†K †g‡Sq Quy‡o †dj‡Q| Avwg I¸‡jv †S‡o gy‡Q Zy‡j w`‡q ejZvg, ÔIiKg Quy‡o †d‡j w`‡qv bv, nvwb|Õ
wKš‘ ÔnvwbÕ wRwbm¸‡jv Avevi Zvi nv‡Zi  Kv‡Q cvIqv gvÎ Quyo‡Z ïi“ KiZ| Gfv‡e Kg c‡¶ `k †_‡K c‡b‡iv evi wRwbm¸‡jvi DÌvb-cZ‡bi ciB GKRb evevi †ev‡av`q N‡U †h, Zvi eis wRwbm¸‡jv †hLv‡b †h-Ae¯’vq Av‡Q, †mLv‡b  †m-Ae¯’vq _vK‡Z †`qv DwPZ| Gw`‡K, †QvU n‡jI GB †LjvwU Pjvi mgq wkïwU wbðq ey‡S †M‡Q †h, †jvKwU gRvi; †evKv wKš‘ gRvi|
Avwg hLb †QvÆ wQjvg, ZLb †_‡K eZ©gvb mg‡qi wcZvi `vwqZ¡ A‡bK cwiewZ©Z| Avm‡jB mš—vb cvj‡bi e¨vcv‡i GKRb wcZvi f~wgKv †h Kx, Avwgmn A‡bK evevB GLb Avi Zv Rvb‡Z AvMÖnx bq| GUvi KviY m¤¢eZ GKUvBѯ¿xi Dcw¯’wZ‡Z (Ges Abycw¯’wZ‡ZI) mš—v‡bi KvQvKvwQ †_‡K PzcPvc Zv‡`i R‡b¨ cÖ‡qvRbxq ¯¿xi dzU digvm LvUvi e¨vcviUvB| G‡Z Avcbvi wcZ…‡Z¡i Aegvbbv NUvi KviY _vK‡Z cv‡i e‡j Avcwb g‡b Ki‡Z cv‡ib|ÑwKš‘ Zv‡Z †Kej nZvkv †eva Kiv Qvov Avcbvi Avi KxB ev Kivi Av‡Q?
mßvn K‡qK Av‡M| Avgvi ¯¿x Avgv‡K Nyg †_‡K RvwM‡q ejj, ÔI‡Vv, wK‡P‡b wM‡q ev”Pv‡`i Rb¨ bvkZvi e¨e¯’v K‡iv|Õ
ÔwKš‘ Wvwj©s,Õ Avwg AvcwË Rvbvjvg| ÔGLb †Zv gvÎ †fvi QqUv...Õ
ÔZvB!Õ Avgvi ¯¿x Avo‡gvov fvOj| ÔZvn‡j wVK †fvi QqUvB n‡e| KviY Avwg Rvwb, Zzwg Lye PgrKvi mgq ej‡Z cvi| wKš‘ GLb I‡Vv, bx‡P wM‡q ev”Pv‡`i Rb¨ cÖvZtiv‡ki e¨e¯’v K‡iv| Iiv †L‡q ¯‹z‡j hv‡e| Õ
ÔwKš‘ †fvi QUvq LvIqv `vIqv..B‡q,, gv‡b I‡`i e`nRg n‡Z cv‡i| gvÎ ev‡iv NÈv Av‡MB †Zv †L‡jv..Õ
Avwg Avevi Nywg‡q cojvg| ¯^‡cœ †`Ljvg, A¨v›UvK©wUKv gnv‡`k ågY KiwQ K¨v‡Þb ¯‹‡Ui mv‡_| GiKg ¯^cœ †`Lvi gv‡b Kx? m¤¢eZ eidkxZj cvwbi cÖfve| Avgvi ¯¿xB †X‡j †`‡qwQj Zv, Avgvi gv_vq|
AMZ¨v DV‡Z n‡jv| g‡b g‡b Avgvi iv‡R¨ cÖPwjZ eD Zvjv‡Ki AvBb¸‡jv‡K LwZ‡q †`L‡Z †`L‡Z bx‡P bvgjvg|
 †eKb, m‡mR, wWg BZ¨vw` wb‡q cÖvZtiv‡ki Av‡qvRb Ki‡Z hvw”Q, Ggb mgq Pvi eq‡mi Kb¨vwU wM‡q mycÖfvZ  Rvbvj|
ÔmycÖfvZ!Õ Avwg GK Mvj nvmjvg| ÔZzwg Kx Lv‡e e‡j fveQ?Õ
ÔP‡Kv‡jU †KK|Õ
ÔP‡Kv‡jU †KK! mKv‡ji bvkZvq P‡Kv‡jU †KK...GKUz A™¢~Z g‡b n‡”Q bv? Zv...wVK Av‡Q|Õ
P‡Kv‡jU †KK evbv‡Z Kx Kx jv‡M †f‡e wbjvg| `ya, wWg, AvUv...me¸‡jvB cywóKi|
ÔP‡Kv‡jU †KK PvI, bv? GB †h...LvI|Õ
Gici Avgvi Ab¨vb¨ †Q‡j‡g‡qiv bx‡P bvgj Ges ejvB evûj¨, IivI cÖ_gRb‡K AbymiY Kij|
 AZGe Avgvi cuvP †Q‡j‡g‡q cÖvZtiv‡k P‡Kv‡jU †KK †L‡Z †L‡Z MvB‡Z jvMj:
evev, Zzwg fvj evev
Zzjbv †bB hvi
P‡Kv‡jU †KK †L‡Z
eo gRv`vi|
Avgv‡`i cvwU© Avgvi ¯¿xi bx‡P bvgv ch©š— ¯’vqx n‡jv| 
Ô†KK di †eªKdv÷!Õ Avgvi ¯¿xi KÉ GKjv‡d bxPZjv †_‡K †di †`vZjvq DVj| Ô†Kv_vq  †c‡qQ †Zvgiv Gme?Õ
Avi Agwb Avgvi Av`‡ii cuvP iZœ evevi cÖwZ Zv‡`i K…ZÁZvi K_v †egvjyg fy‡j wM‡q GK ev‡K¨ gv‡K Rvbvj, ÔevevB w`‡q‡Q|Õ Ges Zvi mv‡_ AvUeQ‡iiwU Av‡iKUz fv‡jvgvbyl †m‡R ejj, ÔAvgiv †Zv wWg Avi i“wU †L‡Z †P‡qwQjvg...|Õ
Avgvi cuvP mš—v‡bi wcZ„Z¡ GKUv wRwbm nv‡o nv‡o †Ui †c‡q‡Q †h, ev”Pv‡`i Øviv meB m¤¢e| GUv GK`g mZ¨ K_v, hv‡K e‡j wPiš—b| Avcbvi KxB ev ejvi Av‡Q, hw` †h †Kv‡bv e¨vcv‡iB GKUv ev”Pv Zvi GKUv wcÖq Dw³ ÔAvwg Rvwb bvÕ e‡j Zvi `vwqZ¡ †kl K‡i?
ai“b, Avcwb †Kv‡bv Kvi‡Y Avcbvi †Q‡ji iƒ‡g Xy‡K †`L‡Z †c‡jb, †m `yÕ nv‡Z wb‡Ri Pzj a‡i Uvb‡Q, †hb IUv AvMvQv, wQu‡oB †d‡j †`qv DwPZ|
Avcwb Ae¯’v †`‡L KZ©e¨ I ggZvi e‡k wR‡Ám Ki‡jb, ÔKx e¨vcvi? Pzj UvbQ †Kb? gv_ve¨_v Ki‡Q?Õ
ÔRvwb bv!Õ Avcbvi †Q‡ji Reve|
ÔRvb bv!Õ Avcwb GKUz AevK n‡jb| GZ eo †Q‡j wb‡Ri mywe‡a-Amywe‡ai K_vI ej‡Z cv‡i bv! Ô Zv †Zvgvi gv_vUv †Zvgvi Nv‡oi Ici Av‡Q †Zv?Õ
ÔRvwb bv,Õ †Q‡ji GK Reve|
GUv Zey mn¨ Kiv hvq| hvi gv_vi Lei †m wb‡RB hLb Rv‡b bv, ZLb AvcwbI Ôbv-Rvb‡jÕ e¨vcviUv dzwi‡q hvq| wKš‘ mgm¨v ev‡a ZLbB, hLb Av‡iKRb Mjv dvwU‡q †PuPvq, †hb Ifv‡e bv-†PuPv‡j IUv‡K wVK Kvbœv ejv hv‡e bv|
Avcwb cÖvYcY †Póv Ki‡Qb Kvbœv _vgv‡Z| †Pv‡Li cvwb Uvwb gy‡Q w`‡”Qb Avi Rvb‡Z Pv‡”Qb Ggb †K †jvK, hvi Nv‡o `y‡Uv gv_v Ges †h Zv‡K Kuv`‡Z eva¨ K‡i‡Q? wKš‘ Zv‡K †MÖdZvi K‡i g„Zz¨`Ê †`qvi cÖ¯—ve Avcbv‡K cvëv‡ZB n‡e, hLb Avcwb Rvb‡Z cv‡eb †h, †m Avi †KD bq, AvcbviB Av‡iK iZœ|
Ô†m Avgv‡K e‡K‡Q,Õ †QvÆ µ›`mx Awf‡hvM Rvbvj|
`yB Kb¨vi g‡a¨Kvi fqven Uª¨vwRK NUbvwUi m~ÎcvZ Zv‡`i gv‡qi GKwU wm鯋vd© civi AwaKv‡ii Ø›Ø †_‡K| Zr¶Yvr eo Kb¨v‡K WvKv n‡jv|
ÔwKš‘ gv †h †Zvgv‡K IUv ci‡Z eviY K‡i‡Q?Õ eo †QvU‡K ¯§iY Kwi‡q w`j|
ÔAvwg Rvwb!Õ †QvU SuvwR‡q DVj| ÔwKš‘ ZvB e‡j ZzwgB †mUv Avgvi KvQ †_‡K †K‡o wb‡Z cvi bv|Õ
 †QvUi hyw³I d¨vjbv bq| AZGe Avcwb †QvUi c¶ wb‡q Zvi gvi GRjv‡m nvwRi n‡jb| Zvi eyw×-we‡ePbvi cÖwZ h‡_ó kª×v‡eva K‡É cÖKvk K‡i Rvb‡Z PvB‡jb, ÔAvgv‡`i †QvU Kb¨v m¤¢eZ †QvULvU GKUv bvf©vm †eªKWvD‡bi wkKvi n‡Z hv‡”Q, hw` bv †m wKQy¶‡Yi R‡b¨ n‡jI †Zvgvi ¯‹vd©Uv ci‡Z cv‡i| Zvi IUv ci‡Z bv-cvivi we‡kl †Kv‡bv KviY Av‡Q Kx?Õ
  KviY Av‡Q eB Kx! Ges Avcbvi ¯¿x Zvi fvlvq †mUv Avcbv‡K `k©vjI| Z‡e Avcwb hw` †mUv‡K ÔKviY `k©v‡bvÕ bv-e‡j Ô`š—cÖ`k©bÕ fve‡Z Pvb, Avwg Avcbv‡K evav †`e bv|
Z‡e †h‡nZz Avcwb Avcbvi e³e¨‡K Zvi Kv‡Q cÖwZwôZ Ki‡Z cv‡ibwb, †m‡nZz wb‡Ri iv‡Mi Av¸‡b wb‡R †m× n‡Z n‡Z AMZ¨v ev”Pvi Kv‡Q wd‡i G‡jbÑGes †`L‡jb ev”PvUv gnvb‡›`B Ab¨ wKQy‡Z gMœ n‡q µxovgË|
wKš‘ wQPKuv`y‡b wkï‡`i gZ ¶zä wcZviv AZ mn‡R wb‡R‡`i cvëv‡Z cv‡i bv| Aek¨ e¨w³we‡k‡l Gi cwigvYMZ ZviZg¨ _vK‡Z cv‡i, wKš‘ wcZv nIqvi Av‡iKUv w`K n‡jv me©‡Zvfv‡eB Avb›`-†e`bvi E‡aŸ© _vK‡Z †Póv Kiv|
wkï‡`i g‡b bv-ivLvi kw³I AmvaviY, †Kej †hUv Zviv ivL‡Z Pvq †mUv Qvov| ai“b, Avcwb wjwfsiƒ‡g e‡m‡Qb| nVvr g‡b n‡jv, Avcbvi PkgvUv IciZjvq †d‡j G‡m‡Qb| wKš‘ Avjm¨ekZ †mUv Avb‡Z †h‡Z Avcbvi B‡”Q Ki‡Q bv| Ggb mgq †`Lv †Mj Avcbvi cuvP eQ‡ii wcw”PUv Avcbvi nv‡Zi Kv‡QB AZ¨š— g‡bv‡hvMmnKv‡i GKUv A¨vw›U‡Ki aŸsmKv‡h© w©jß nIqvi Zv‡j Av‡Q| AZGe Avcwb Zv‡K ûKzg w`‡jb Ici †_‡K Avcbvi PkgvUv wb‡q Avmvi R‡b¨|
ÔG¶ywY hvw”Q, evev|Õ ev”PvUv GK K_vq ivwR n‡q †Mj| GLb Avcwb Zv‡K PkgvUv Ici Zjvi wVK †Kvb RvqMvq (weQvbvi Wvbw`‡Ki †UwejUvi Ici) †i‡L G‡m‡Qb, Zv e‡j w`‡jb| †m mv‡_ Avcbvi †eWiƒgUvi †jv‡Kkb Rvbv‡ZI fyj‡jb bv| wKš‘ gykwKj evaj Ab¨Î| Avcbvi cuvP eQ‡ii †g‡q Wvb †P‡b bv, evgI †ev‡S bv|
ÔGB nvZ,Õ Avcwb Zv‡K †evSv‡Z †j‡M †M‡jb| Ô†Zvgvi GB nvZUvB n‡jv Wvb nvZ, GUv w`‡qB †Zv Lvevi LvI, ZvB bv? myZivs Zzwg †eWiƒ‡gi `iRvq `uvwo‡q GB nv‡Zi w`‡KB G‡Mv‡e| e¨vcviUv fvix gRvi n‡e, ZvB bv?Õ Avcwb Zv‡K wKQyUv DrmvnI †hvMv‡jb|
wKQy¶Y ci Avcbvi  g‡b  n‡jv, ev”PvUv Pkgv Avb‡Z Lye †ewk mgq wb‡”QÑGes ZLbB Avcwb †`L‡jb, †m Avcbvi †Pqv‡ii cvk w`‡q †nu‡U hv‡”Q|
ÔgvgwY, †Zvgv‡K bv PkgvUv Avb‡Z e‡jwQjvg?Õ Avcwb Zv‡K ai‡jb|
ÔI¸‡jv †h ILv‡b †bB, evev,Õ Avcbvi gvgwY Avcbv‡K Lei Rvbvj|
AZGe Le‡ii mZ¨Zv hvPvB Kivi R‡b¨ Avcwb Zv‡K wb‡qB Ici Zjvq †M‡jb Ges †`L‡jb, I¸‡jv †gv‡UB ¯’vb cwieZ©b K‡iwb|
ÔwKš‘ evev,Õ Avcbvi Kb¨vi wibwi‡b KÉ evRj| ÔAvwg hLb LuyR‡Z G‡mwQjvg, ZLb I¸‡jv GLv‡b wQj bv †Zv!Õ
Gevi, Avgvi g‡b nq bv †KDB, Ggb Kx GKRb gb¯—Ë¡we`I ej‡Z cvi‡e †h, Avcbvi Kb¨vi mv¶¨vbyhvqx I¸‡jv ZLb †mLv‡b wQj wK wQj bv| gb¯—Ë¡we` nq‡Zv GiKg e‡j em‡Z cv‡ib, wZwb G‡Z wkï gb¯—Ë¡ †evSvi R‡b¨ `vi“Y wk¶bxq GKUv wRwbm cv‡”Qb| Z‡e Avcwb hv wkL‡jb, Zv n‡jv, Pkgvi R‡b¨ wb‡RiB hvIqv DwPZ; K¶‡bv ev”Pv‡`i cvVv‡Z †bB| Avi GUv‡KB e‡j wcZ…Z¡|
hLb †`L‡Z cv‡eb †h, Avcbvi ev”Pviv Avcbvi wbqš¿Y †_‡K wb‡R‡`i ¯^vaxb Kivi †Póv Ki‡Q, ¶zYœ n‡eb bv| eis GUv †f‡e mvš—¡bv cvIqvi †Póv Ki“b †h, ¯^qs weavZvI Zvi mš—vb‡`i Ici wb‡Ri cÖfve we¯—vi Ki‡Z cv‡ibwb| ¯^M© Ges c„w_ex ˆZwi Kivi ci weavZv hLb Av`g Avi nvIqv‡K m„wó Ki‡jb, ZLb Zv‡`i D‡Ï‡k me©cÖ_g †h-kãUv D”PviY K‡iwQ‡jb, †mUv n‡jv, ÔK‡iv bv|Õ
ÔKx Kie bv?Õ Av`‡gi wRÁvmv|
Ôwbwl× dj f¶b  K‡iv bv,Õ M‡Wi M¤¢xi Reve|
ÔIUv †Kv_vq?Õ Av`‡gi cybtwRÁvmv|
ÔIUv GLv‡bB Av‡Q,Õ weavZvi wew¯§Z Reve| fve‡jb, nvwZi gZ Rš‘ m„wó Kivi ciI Zuvi m„RbxK‡g©i wbe„wË NUj bv †Kb?
K‡qK wgwbU ci| weavZv †`L‡jb Av`‡gi nv‡Z M›`g, Ava LvIqv|
Ô†Zvgv‡`i IB dj †L‡Z wb‡la Kwiwb?Õ

Ônuy,Õ Av`‡gi jvRyK Reve|

Zvn‡j Lv”Q †Kb?Õ weavZvi i“¶ cÖkœ|
ÔAvwg Rvwb bv,Õ Nvo †MvuR K‡i Av`‡gi DËi|
Gici, ag©MÖ‡š’i fvlvfw½ bKj K‡i ej‡Z †M‡j : Ck¦‡ii kvw¯— gvby‡li Ici bvwgqv Avwmj| Av`g I nvIqv mš—vbcÖvß nB‡jbÑGes GB iƒ‡c Zvnv gvby‡li Rb¨ cÖ‡hvR¨ nBj, hvnv Avi KLbI cwiewZ©Z nB‡e bv|
ZvB e‡j AvcwbI †hb Hk¦wiK kvw¯—i AbyKi‡Y gvbweK kvw¯— cÖ‡qvM Ki‡Z h‡eb bv| Avcbvi ev”Pv‡`i Avcwb I‡`i gZ K‡iB †e‡o DV‡Z w`b| G‡Z †L` cÖKvk Kivi wKQy †bB|  KviY c„w_ex Luy‡RI Avcwb Ggb GKRb evev cv‡eb bv, whwb Zvi ev”Pv‡`i Zvi wn‡me Abyhvqx eo Ki‡Z †c‡i‡Qb| kvw¯—i K_v hw` e‡jb, †mUv †Zv †ZvjvB iBj I‡`i eo nIqvi R‡b¨| 
KviY wcZ…Z¡ wKsev gvZ…Z¡ Zv‡`iI eiY Ki‡Z n‡e|

[wej Kmwei Ô`¨ wKWmÕGi msw¶ß iƒ‡ci evsjv iƒcvš—i]





সুনম সাদেক

অন্তরজোড়া এক বেদনার নাম সুনম সাদেক
হারিয়ে যাওয়া এক স্বপ্নের নাম সুনম সাদেক।

সারাদিন
জীবনের কোলাহলে কেটে যায়
শূন্যতা নেমে আসে দিনশেষে বিষণ্ন সন্ধ্যায়
তখন অন্ধকারে দূরাকাশে ফুটে থাকে তারা এক
বেদনায় আলোকিত সে তারার নাম সুনম সাদেক।

এ জীবন
জানি আলোকবর্ষ ছোঁবে না
তাই কোনোদিন সে তারার কাছেও যাওয়া হবে না
অজানা তারার মতো থেকে যাবে যে নাম এক
অন্তরজোড়া সে তারার নাম সুনম সাদেক।

জনকের ছায়া (গল্প)

দক্ষিণের ফিনফিনে বাতাস গা জুড়িয়ে দেয় নিমেষেই। এতক্ষণ ধরে সূর্যের তাপ, গুমোট আর ঘাম মিলে শরীরের জন্যে যে প্রাণান্তকর অবস্থার সৃষ্টি করেছিল, দ্রুত সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটল। সারা শরীর, প্রতিটি লোমের গোড়া স্বস্তির নিশ্বস ফেলে যেন চাঙা হয়ে ওঠে।
গরুদুটোও হাঁসফাঁস করছিল। ভোঁস ভোঁস নিশ্বাসের সাথে নাকের ছেঁদোয় শ্লেষ্মা জমে জমে এক ধরনের ঘ্যাড় ঘ্যাড় শব্দ হচ্ছিল। ভাদ্র মাসের রোদ মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে মাঝে মাঝে গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে, কাদা উঠে উঠে পেট-পিঠ একাকার, মাছি আর ডাঁশের দল মচ্ছব পেয়ে ভন ভন করছে--স্পষ্টতই বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছিল তাদের ঘন ঘন লেজ সঞ্চালনে। দখিনা বাতাসের ফিনফিনে পরশ পেয়ে বোঝা যায়, খুশি হয়েছে তারাও।
ঠিক মাথার ওপর থেকে বিঘতখানেক পুবে হেলে আছে সূর্য। কদম আলীর পেটের ভেতর গুড় গুড় শব্দ ওঠে। পিপাসাও পেয়েছে খুব। ছেলেটা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাপের হাল চষা দেখেছে। ভাঙাচোরা আইল বেঁধেছে জমি থেকে খাবলা মেরে মাটি তুলে। ঘাসটাস বেছে দিয়েছে। সে থাকলে তাকে পানির জন্যে পাঠানো যেত। কিন্তু রোদের তেজ দেখে কদম আলী নিজেই তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে বিল থেকে।
ধারে কাছে বাড়ি-ঘর নেই। বিস্তীর্ণ বিলের মাঝে সে একা। চারপাশে রোপা আরোপা ধানের জমি। এমন প্রায় হয় না। এখন রোপার মৌসুমে নির্জন বিলের কথা ভাবা যায় না। তবু আজ সে একা। বিলের দক্ষিণ ও উত্তর-পশ্চিমাংশে যারা আছে, তাদের সঙ্গী হিসেবে নেয়া যায় না। এখান থেকে ডেকে গলা ফাটালেও সে-ডাক তাদের কানে পৌঁছবে না। সুতরাং তাদের কাছে পানি থাকতে পারে, এ আশা করা গেলেও আশা পূরণের অবকাশ নেই এবং যদিও পানির ঠাণ্ডা, তরল স্বাদের কথা ভেবে কদম আলীর শুকনো কণ্ঠ-তালু চনমন করে উঠছে, তবু আপাতত ধৈর্যসহকারে কারবালা ময়দানের নজির টেনে মনকে বোঝানো ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
এ-মুহূর্তে হাতেম আলী তরফদারের সুরেলা পুঁথির টান তার মনের ভেতর গুঞ্জন তুলতে চায়। তার গলা ভাল নয়, শ্লেষ্মাজড়ানো ফ্যাঁশফ্যাশে। তবু এ-রোদ্দুরে পিপাসায় ক্লান্ত শুকনো গলায় সুর তুলতে যায় সে। কিন্তু রাত জেগে ‘জঙ্গে কারবালা’ শুনলেও ছাড়া ছাড়া দু’একটা লাইনই কেবল তার মনে থাকে। এ-মুহূর্তে তাই গলা ছাড়তে গিয়ে কেবল ‘পানির পিয়াসে মর্দের ছাতি ফেটে যায়’-এই লাইনটিই মনে আসে। তবে তাতে খুব একটা অসুবিধে হয় না। দখিনা বাতাসের হালকা পরশ তার শরীরের মত বুকের ভেতরটাও হালকা করে দেয়। গলায় শ্লেষ্মা নিয়েই তাই সে লাইনটাকে বারবার কাজে লাগায়।
কিন্তু শীঘ্রই তার গলায় ভাটা পড়ে। হঠাৎ আসা পলকা বাতাস হঠাৎ চলে যায়, সে টেরও পায় না। গনগনে রোদ তাকে সেদ্ধ করতে থাকে অনবরত। তার  মনে হয়, মাথার তালু গরম হয়ে ভেতরের মগজ টগজ সব গলে গলে নেমে আসছে চুল, কানের গোড়া, কপাল আর চোখের কোণ বেয়ে। পাকানো কালো হাতের চামড়া, তালু ভিজে চটচটে, ময়লা; পাতলা লোম খাড়া হয়ে আছে পোড়ামাটিতে গজানো শ্রীহীন, উস্কখুস্ক  ঘাসের মত।
ডাঙায় তোলা মাছের মত দমের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকে সে। মেঘভাঙা রোদ বাঘের মত লাফিয়ে পড়ে তার ঘাড় মটকে দেয়। সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং এক সময় ফোরাত নদীর পাড়ে কারবালা প্রান্তরে তাঁবুর ভেতর বন্দী শিশু আসগরের পিপাসায় ককিয়ে ওঠা কান্নার মতই মনে হয় তার নিজের গলার স্বরকে।
 সে কিছুক্ষণ চুপচাপ ধুঁকতে থাকে। গরুদুটোর লেজ মুচড়ে দেয় ‘হেট হেট’ বলে। জিভ আর তালুর সংঘাতে শব্দ সৃষ্টি করে উৎসাহ দেয়। ডাঁশ আর মাছির অবিরত জ্বালাতনের প্রতিবাদে লেজ নাড়ানোয় ব্যস্ত গরুদুটো ভোঁস করে সাড়া দেয় তাতে। হাঁটুপানি আর কাদা ভেঙে হাঁটার গতি বাড়নোর চেষ্টা করে।
কদম আলীর পেটের ভেতর  আবার গুড় গুড় শব্দ ওঠে। কিন্তু তাতে মনেযোগ দিতে চায় না সে। তবে পিপাসার ব্যাপারে মনেযোগ দিতে তার আপত্তি থাকে না। সে ঢোক গিলে বারবার গলা ভেজাতে চায়। প্রথম সুযোগেই লম্বা একটা দম নিয়ে এক জগ ঠাণ্ডা, অতি ঠাণ্ডা পানি গলাধঃকরণ করার কথা ভেবে লোভাতুর হয়ে ওঠে। কিন্তু সে শীঘ্রই ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং তার পিপাসা ক্রমে তীব্রতা লাভ করে। সুতরাং সে অন্যমনস্ক হয়ে পিপাসা ভোলার জন্য আবার গান গাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। কিন্তু কোনো গানই তার পুরোপুরি মুখস্থ নয়। তবে অনেক রকম গানের ছুটকা ছাটকা লাইন মনে আছে। সে কিছু লাইন মনে মনে আওড়ায়, কিন্তু মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে না একটাও। শেষে বোধ হয় একটা লাইন তার ভরী মনে ধরে যায়। সে কিছুক্ষণ লাইনটি নিয়ে নাকে গুন গুন করে। এক সময় গলায়ও ধরে বসে। এই পিঠফাটা ভাদ্রের রোদ্দুরে গানের লাইনটা খাপে খাপে মিলে যায়। এরকম যুৎসই একটা গান মনে করতে পেরে নিজের ওপর ভারী খুশি হয়ে ওঠে সে। তার খুশির ভাগ সে গরুদুটোকেও দেয়। জিভ আর তালুয় শব্দ সৃষ্টি করে লেজ মুচড়ে দেয় ‘হেট হেট’ বলে। তারপর গলা ঝেড়ে শ্লেষ্মা সরিয়ে আবার গেয়ে ওঠে: আল্লা, মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে তুই...
কিন্তু ভাদ্র মাসের মেঘ ত্যাঁদড় কম নয়। আকাশের এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে জটলা পাকালেও কদম আলীর ডাকে সাড়া দিয়ে ছায়া দিতে এগিয়ে আসে না। আর সূর্যটাও যেন আল্লাহর সাথে কদম আলীর ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে দ্বিগুণ রাগে জ্বলতে থাকে।  গান গাইতে গাইতে কদম আলী দূরে, দক্ষিণে সরকারদের জমিতে কামলাদের ধান রোপা দেখে। মনে মনে হিসেব করে, কম পক্ষে বিশ-বাইশ জন  লোক নেমেছে ধান রোপায়। মানুষগুলো রুকুর ভঙ্গিতে পশ্চিমে ঝুঁকে পুব দিকে পিছু হটে যাচ্ছে। এতদূর থেকেও সে তাদের হাতের দ্রুত ওঠা নামা আঁচ করতে পারে। মানুষগুলো বোঝা যায়, বেশ ফুর্তিতে আছে। এমন মাঠজ্বলা রোদের ভেতরেও গান গাইছে তারা। গানের কথাগুলো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু সুরটা ঠিকই ধরা যায়। পাইন্যা সাইর।
পাইন্যা সাইর গাইতে তারও খুব ভাল লাগে। কিন্তু মুশকিল হলো, কোনো গানই তার পুরোপুরি মনে থাকে না। পাইন্যা সাইরের আল্লা-রছুল, মা ফাতেমা, হজরত আলী, পাঁচ পীর আর পাঁচ কলেমা--এই কয়টি কথাই এখন তার এলোমেলোভাবে মনে পড়ছে। কিন্তু এভাবে এলোমেলো শব্দ গেঁথে গান গাওয়া যায় না। নইলে সেও আরম্ভ করত এখন। হোক সে একা। তাতে কী? একা একা গান গাওয়ারও আলাদা একটা মজা আছে। অন্তত কিছুক্ষণ তো সব কিছু ভুলে উদাস হয়ে থাকা যায়। কদম আলী হঠাৎ আবিষ্কার করে, এতক্ষণ সে ‘আল্লা মেঘ দে, পানি দে’ গেয়ে পিপাসা ভুলেছিল।
 সে এখন আর আগের মত তীব্রভাবে পিপাসা বোধ করছে না। দূর  হতে ভেসে আসা ‘পাইন্যা সাইর’এর করুণ সুর তার ভেতরে এক ধরনের উদাসীনতা সৃষ্টি করেছে। ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে সারা মাঠ ঝলসে যাচ্ছে। রোপা আমন ধানের কচি চারাগুলো ঘোলা পানির ওপর হলুদ পাতা জাগিয়ে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের কিনারায় ধূসর কালো মেঘ থমকে আছে নির্লিপ্তের মত। দু’একটা চিল মাঝে মাঝে মাথার ওপর তীক্ষ্ম করুণ সুরে ডেকে উঠছে। চারদিকের সমস্ত নৈঃশব্দ্য চিরে চিরে যাচ্ছে তাতে আর কানের ভেতর ঝিম ঝিম করে উঠছে। কদম আলী নিজেকে হঠাৎ খুব একাকী অনুভব করে। দক্ষিণ দিক হতে ভেসে আসা ‘পাইন্যা সাইর’এর অস্পষ্ট সুর যেন ঝাঁঝাঁলো দুপুরের সমূহ তীব্রতায় চারদিক থেকে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সে অন্যমনস্কভাবে, অনেকটা অভ্যাসের বশেই গরুদুটোর লেজ মুচড়ে দেয়। জিভ আর তালুয় শব্দ সৃষ্টি করে না, পাছে তার অখণ্ড মনোযোগে ফাটল ধরে।
‘বুইজলি কদম, গান বড় ভালা জিনিস রে। গান হুইনলে মন ছাফ থাকে, শরীর ভালা থাকে। যেঁইক্তে তুই গান হুইনবি, গানের মতন গান অইলে হেঁইক্তে তোর মনে কন’ দুক্ক থাইকত ন’।’
বাজান গল্প করত কদম আলীর সাথে। বাজানের কথা মনে হতেই তার মন গলে যায় বাজান খুব ভাল গান গাইত। সেই কৈশোরে সে যখন বাজানের সাথে মাঠে যেত, তখন বুঝতে পারত, মাঠের আর সকলের গলার ওপরেই তার বাজানের গলা। গানের সুরে বাজানের মাথা দুলত আর বাতাসে উড়ত তার বাবরী চুলের গোছা। কদম আলী আইলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকত আর মন দিয়ে তার বাজানের গান শুনত। বাজানকে তার অন্য রকম মনে হতো তখন। বাজান যেন রাজা আর কামলারা, যারা বাজানের গানের দোহার টানত, তারা সব প্রজা। অথবা বাজান ওস্তাদ, আর তারা সব সাগরেদ। কদম আলীর বুক গর্বে ভরে উঠত। তার বাজানের মত গান কেউ গাইতে পারে না। তার খুব ইচ্ছে হতো, বড় হলে সেও বাজানের মত বিরাট গায়েন হবে।
 সেসব কত কাল আগের কথা। অথচ মনে হয়, মাত্র সেদিন। এখনো চোখের সামনে জ্বল জ্বল করছে সন্ধের সময় ঘরে ফেরা বাজানের রোদে পোড়া ক্লান্ত অথচ শান্ত মুখ। বাজান সবাইকে নিয়ে এক সাথে রাতের ভাত খেত। তারপর মার হাতে সাজিয়ে দেয়া হুঁকোয় চোখ বুজে গুড়–ক গুড়–ক করে তামাক টানত। তার চারদিকে ধোঁয়ার মেঘ ভেসে বেড়াত আর তামাকের কটু গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠত। মা সুপুরি কেটে পান বানাত। চিকন ফালির খিলি পান। তারপর পিতলের পানদানীর চারদিকে সাজিয়ে দিত। এক সাথে দশ-বারো খিলি। খুব পান খেত বাজান।
বাজান মাঠে গান গাইত, মাঝে মাঝে রাত্রে ঘরের আঙিনায় পাটি বিছিয়ে গানের আসর বসাত। শীতের প্রথমে মাঠ থেকে আমন ধান কাটার পালা শেষ করে সবাই যখন হাত-পা ঝেড়ে একটু সুস্থির হয়েছে, তখনই শুরু হতো গানের আসর। পাড়ার হাশেম চাচা, বনির বাপ জেঠা, গওহর আলী, লতু মামা--সবাই আসত সে আসরে। তাদের চারপাশে গোল হয়ে বসত, যারা গান শুনতে আসত তারা। গান গাইত বাজান, মাঝে মাঝে অন্যেরা মিলে দোহার টানত। আস্তে আস্তে রাত বাড়ত। শীতের চাঁদ ফুটফুটে আলো ছড়াতে ছড়াতে এক সময় পশ্চিমে হেলে পড়ত। তখ ভাঙত আসর। কদম আলী বাজনের গান শুনত। শুনতে শুনতে এক সময় ঢুলতে শুরু করত। তারপর ঘুমিয়ে পড়ত বাজানের কোল ঘেঁষে। অনেক রাতে আসর ভাঙলে বাজান তাকে কোলে করে ঘরে নিয়ে নিজের পাশে শোয়াত। সে সময় আধ ঘুমে আধ জাগরণে তার কানে বাজত বাজানের গাওয়া গানের কলি: খাঁচার ভিতর  অচিন পাখি কমনে আসে যায়...
আসলে বাজান বড় গানপাগলা ছিল। গান ছাড়া অন্য কিছু খুব কমই বুঝত। গানই ছিল তার আনন্দ, তার সুখ। কদম আলী নিজেকে তাই খুব দুঃখী ভাবে। সে গায়েন  বাপের ছেলে। ছোটবেলায় বাজানের মত গায়েন হওয়ার তারও খুব ইচ্ছে ছিল--কিন্তু শেষ পর্যন্ত গান তার দ্বারা হয়নি। তার গলা ভাল নয়, ফ্যাঁসফেঁসে; তা ছাড়া কোনো গানই দু’এক লাইনের বেশি সে মনে রাখতে পারে না। সে জন্যে বুঝি তার রাগও ধরে নিজের ওপর। কিন্তু কিছুই করার নেই। গলা তো কেউ নিজে বানাতে পারে না, খোদায় না দিলে। তবে গান গাইতে না পারলেও  শোনার অভ্যাস সে বাজানের কাছে ঠিকই পেয়েছে। গান শুনেই সে গাইতে না-পারার দুঃখ ভোলে।
কদম আলী এসব ভাবতে ভাবতে খুব আনমনা হয়ে যায়। বাতাসহীন দুপুর প্রকৃতির অসহ্য গুমোট আর তপ্ত রোদ তার মাথার তালু ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যায়। তারপর লোমকূপের গোড়া বেয়ে বিগলিত ঘামের অবিরাম ধারায় দর দর বেগে নেমে আসে নিচের দিকে। ঘাড় থেকে, কপাল থেকে বুকে-পিঠে, বুক-পিঠ বেয়ে কোমরের দিকে। বাজানের কথা ভেবে তার মন কাদা কাদা হয়ে যায়। হঠাৎ তার খেয়াল হয়. বহুদিন ধরে সে বাজান আর মার কবর জেয়ারত করেনি।
 জেয়ারত করতে গেলে খরচাপাতি আছে, মোল্লা-মৌলভীদের পয়সা দিতে হয়। সে নিজে জেয়ারতের নিয়ম টিয়ম জানে না। জেয়ারত করতে গেলে আরবিতে দোয়া-দরুদ পড়তে হয়। আল্লার খাছ রহমতের ভাষা আরবি, সে মোল্লা-মৌলভীদের ওয়াজ করতে শুনেছে। বাঙলায় নাকি জেয়ারত হয় না। এ জন্য কদম আলী এখন খুব দুঃখবোধে আক্রান্ত হয়। অনুতাপে তার বুক ভেঙে যেতে চায়। ছোটবেলায় বাজান তাকে মক্তবে দিয়েছিল। কিন্তু মক্তবে পড়ার চেয়ে মক্তব থেকে পালানোতেই কদম আলীর ঝোঁক ছিল বেশি। শেষে বাজান তাকে বাড়িতে বসিয়ে ছুরা-কেরাত শিখিয়েছিল কিছু। কোনোমতে নামাজ পড়ার উপযোগী করে। তবে সেসব পুরোপুরি মুখস্থ আছে কিনা কদম আলী এখন আর তা হলফ করে বলতে পারবে না।
নামাজ সে পড়ে না। অথচ জানে, মোছলমানের ফরজন্দ সে, নামাজ তাকে পড়তেই হবে। আজ হোক, কাল হোক কিংবা হোক দু’দিন পরে। নইলে হাশরের দিন আল্লাহর পাওয়ার কোনো আশা নেই। দোজখের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরতে হবে অনন্তকাল। অনন্তকাল বলতে ঠিক কতটা সময়, বুঝতে পারে না কদম আলী। তবে তা যে খুব কম সময় নয়, তাতে তার কোনো সন্দেহ নেই। হয়তো তা লাখ লাখ কোটি কোটি  বছর কিংবা তার চেয়ে আরো অনেক বেশি। একমাত্র আল্লাহ্ই তার সঠিক হিসেব জানে। কিন্তু সে মাঝে মাঝে খুব আশ্চর্য বোধ করে। একটা মানুষের বয়সের সীমার তুলনায় লাখ-কোটি বছর তো বিরাট ব্যাপার। তাহলে মানুষের বয়স এত কম হয় কেন? আর এই সামান্য, বলতে গেলে সাগরের বুকে এক ফোঁটা পানির সমান সময়ের জন্য দুনিয়াতে আসাই বা কেন? এবং এ সামান্য সময়ে জীবনের ভাল-মন্দের বিচারে অনন্ত কালের বেহেস্ত কিংবা দোজখ, তাও বা কেমন? শেষমেষ তালগোল পাকিয়ে ফেলে সে।        
এরকম মারফতি কাজকারবার নিয়ে সে অনেকদিন ভেবে টেবে দেখেছে। মন দিয়ে হাতেম আলী তরফদারের পুঁথি শুনেছে, বিস্তর শরীয়তী-মারফতি গানটানও শুনেছে। কিন্তু সবকিছুই তবু তার কাছে বিরাট রহস্য। তবে এসব কিছুকে ভুলে থাকা কিংবা অবিশ্বাসের হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়ার শক্তিও তার নেই। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কোনো অলস মুহূর্তে এসব ভেবে রীতিমত বিচলিত বোধ করে। তার ভেতর থেকে কে যেন তাকে হঠাৎ হঠাৎ সাবধান করে দেয়। সে শুধু একধরনের অপরাধবোধে জর্জরিত হতে থাকে।
অপরাধবোধ তার এখনো কাটে না। সে মূর্খ, এটাই তার নিজের কাছে নিজের অপরাধ বলে মনে হয়। দুনিয়া আর আখেরাতের যেসব জটিল তত্ত্ব নিয়ে সে মাথা ঘামাচ্ছে, সেসব নিশ্চয় অসম্ভব প্রশ্ন নয়। এরও জবাব হয়তো কোথাও আছে। কিন্তু সে জবাব একমাত্র তার মূর্খতার জন্যই তার কাছে অস্পষ্ট। কেউ তাকে সেসব বুঝিয়েও দিতে পারে না। কারণ মূর্খতা শুধু তার মধ্যেই নয় নয়, তার আশেপাশে যাদের সাথে তার ওঠা-বসা, তাদের সবার মধ্যেই। তারাও কি কদম আলীর মত এসব জটিল ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায়?
‘বাজান।’
কদম আলী ভীষণ চমকে ওঠে। ‘কে?’
‘আঁই, বাজান। আমনের লাই পানি আইনছি।’
‘পানি আইনছছ?’
দর দর করে ঘাম ঝরছে কদম আলীর শরীর থেকে। কপালের শিরা লাফাচ্ছে তিড়বিড়িয়ে। কান ঝিম ঝিম করছে। এতক্ষণ সে সবকিছু ভুলেছিল। ভাদ্র মাসের টগবগে রোদ, ঝাঁ ঝাঁ আকাশ, চারপাশের হলুদ বিশীর্ণ রোয়ার জমিÑএমন কী, দূর থেকে ভেসে আসা ‘পাইন্যা সাইর’এর মন কেমন করা সুর পর্যন্ত। তার সামনের লাঙলটানা জলজ্যান্ত গরুদুটোর অস্তিত্বও। হঠাৎ ভীষণ ক্লান্তি বোধ করে সে। ছেলের হাতের পানির জগ তার সমস্ত ধৈর্যের  বাঁধ ভেঙে চুরমার করে দিয়ে তাকে টান দেয় সবলে। লাঙল থামিয়ে কোমর থেকে গামছা খুলে নিয়ে হাত, মুখ আর কপাল মুছতে মুছতে আইলের দিকে হেঁটে আসে সে পানিতে থপ থপ করে।
 ছেলে হাত থেকে পানির জগ নিয়ে ঢক ঢক করে পানি খেতে থাকে সে। এক টানে জগের পানি অর্ধেকে চলে আসে। একটু দম নেবার জন্য জগ হতে  মুখ সরিয়ে থামে সে। বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে ঠোঁট কাছায় জমে ওঠা পানি আর ঘাম মোছে।
‘মা আমনের লাই বুলি পিডা পাডাইছে, বাজান।’ কদম আলীর ছেলে কোঁচর  খুলে আটার রুটি বের করে। কদম আলী খুব খুশি হয়ে ওঠে। দুটো রুটি খেলে পেটের খিদে কিছুটা কমবে। আরো ঘণ্টাখানেকের কাজ বাকি আছে মাঠে। হাত বাড়িয়ে ছেলের হাত থেকে রুটিদুটো নিয়ে এক কামড়ে একটা রুটির আধখানা ছিঁড়ে চিবোতে থাকে সে। ঠাণ্ডা, বাসী আটার রুটি। চিবোতে গেলে জিভ, তালু আর দাঁতের গোড়ায় ভ্যাচ ভ্যাচ শব্দ হয়। কদম আলী আরেক ঢোক পানি খেয়ে নেয়।
কদম আলীর ছেলে থামিয়ে রাখা লাঙলের দিকে এগিয়ে যায়। বলে, ‘আমনে জিরান, বাজান। আঁই আস্তে আস্তে চয়ি।’
কদম আলীর মন ছেলের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। এতটুকু ছেলে, তবু দেখো, বাজানকে কেমন জিরোতে বলছে! বাজানের কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছে। ভারী স্নেহে তার বুক ভরে ওঠে। সাথে সাথে কেমন একটা চিনচিনে ব্যথাও জাগে ভেতরে। আবার তার বাজানের কথা মনে ওঠে। খুব ছোট বয়সে জমিনের আইলে দাঁড়িয়ে বাজানের গান শুনতে ভাল লাগলেও একটু বড় হয়ে যখন কাজ-কর্ম করার মত হয়েছে, তখন তাকে আর মাঠে খুঁজে পাওয়া যেত না। বাজান এ নিয়ে সময় সময় রাগ করত। কোনো কোনো সময় বোঝাতÑ--কিন্তু কদম আলীর কী যে হয়েছিল! কাজেকর্মে একদম মন দিত না। বুড়ো বাপকে সাহায্য করার চাইতে এখানে ওখানে আড্ডাবাজি করতেই তার ভাল লাগত বেশি। অবশ্য একদম যে কাজ করত না, তা নয়। তবে তা যে নেহাৎ বাজানের রাগ বা চেঁচামেচির চাপে পড়ে, বুড়ো বাপের প্রতি মমতাবশে নয়, বাজান তা বুঝতে পারত। কিন্তু কদম আলীর তাতে কিছু আসত যেত না। ফাঁক পেলেই আবার সে লাপাত্তা হয়ে যেত।
আসলে কিছু কিছু জিনিস মানুষকে নিজের জীবন থেকে শিখতে হয়, কিছু জিনিস কেউ কাউকে বলে বোঝাতে পারে না। নিজের ছেলের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করতে গিয়ে এ মুহূর্তে কদম আলী অতি সহজে এ সত্যটা বুঝতে পারে। বাজান বুঝি ছেলের কাছে কাজের চেয়ে বাপের প্রতি তার মমত্ববোধটুকুই প্রত্যাশা করত বেশি। কিন্তু মানুষের কিছু কিছু শিক্ষা তখনই হয়, যখন তা আর কোনো কাজে লাগে না।
রুটি চিবোতে চিবোতে কদম আলী দূরে দিগন্তের দিকে তাকায়। ঘোলাটে মেঘে ম্লান দিগন্ত রেখাও যেন তার দিকে চেয়ে থাকে ঝাপসা দৃষ্টি মেলে। হঠাৎ তার চোখ কেমন জ্বালা করে  ওঠে। আহা, বাজান! বাজান গো...
‘পাইন্যা সাইর’এর সুর ভেসে আসছে অবিরাম। হাল চষতে চষতে কদম আলীর ছেলে  গান শোনে। কদম আরী জগের বাকি পানিটুকু শেষ করে ট্যাঁক হতে চীনে কাগজে মোড়ানো বিড়ির প্যাকেট বের করে বিড়ি ধরায়। লম্বা এক টানে একগাল ধোঁয়া গিলে কাশতে কাশতে বলে, ‘আস্তে আস্তে চয়িছ, বাজান। চাইছ, গরু ফাল খাইব।’
কদম আলীর ছেলে কদম আলীকে অভয় দেয়, ‘খাইত ন’, বাজান।’
এরপর সে দক্ষিণ দিকে গান গাওয়া লোকগুলোর দিকে আঙুল উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, পাইন্যা সাইর, না বাজান?’
কদম আলী হাসে। ‘হ্যাঁ।’
হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসা সুরের সাথে কদম আলীর ছেলেও তার রিনরিনে গলা মিলিয়ে দেয়:
ও রে মোহাম্মদ মোহাম্মদ মানি রে জোয়ান
জোয়ান রে, মোহাম্মদ মোস্তফা
ও রে যে জনা মোহাম্মদ মানে রে
মিলে যায় তার খোদা...হায় রে
কদম আলী চমকে ওঠে। ছেলের দিকে অবাক চোখে তাকায়। বাপের সামনে গান গাইতে লজ্জা পাওয়ার মত বোধ-বুদ্ধি তার হয়নি এখনো। ছেলেকে সে গুন গুন করতে কিংবা কখনো গলা ছেড়ে গাইতেও শুনেছে। কিন্তু তাতে অবাক হওয়ার মত কিছু আছে বলে মনে হয়নি। অথচ এখন তাকে গান গাইতে শুনে তার ভেতরে কেমন একটা আলোড়ন জাগে। তার হাতের বিড়ি নিভে আসে। এক মনে ছেলের গান শোনে সে।
জোয়ান রে, আল্লা সে অসীম
আল্লা না চিনিলে রে মনা
কেমনে পাইবা মোহাম্মদের দীন রে...
মরি হায় হায় রে
...একটা ছায়া বড় হচ্ছে কদম আলীর সামনে। ছায়া নয়, অবয়ব। ছোট্ট একটা অবয়ব ক্রমান্বয়ে দীর্ঘ হচ্ছে। একটা মানুষের অবয়ব। তার মুখে পাতলা ফিনফিনে দাড়ি, মাথায় লম্বা চুল, তেলচোপানো বাবরী ছাটা। সে চুল উড়ছে বাতাসে, আর বাবরী চুলের মালিক সে মাথাটা এদিক ওদিক দুলছে। ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে। আর কদম আলী সেদিকে তাকিয়ে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে হতে শেষ পর্যন্ত যেন একটা বিন্দুতে পর্যবসিত হচ্ছে।
‘বাজান।’
সংবিত ফিরে পায় কদম আলী। ছেলের দিকে তাকায়। গরম, ঘাম আর হালচষার পরিশ্রমে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে ছেলেটাকে। তাড়াতাড়ি আইল থেকে জমিনে  নামে সে। পানির জগ নিয়ে কদম আলীর ছেলে আঁকাবাঁকা আইল বেয়ে চলে যেতে থাকে। কদম আলী সেদিকে, ছেলের চলার পথে বারবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। অদ্ভুত একটা সুখে তার বুকের ভেতর তোলপাড় জাগে। হঠাৎ সে ভাদ্র মাসের মেঘভাঙা রোদেভরা ঝাঁঝাঁল আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায়। একটা মেঘ ভাসতে ভাসতে চলেছে সূর্যের দিকে। এক্ষুনি তার ছায়া এসে পড়বে পৃথিবীতে। কদম আলী হঠাৎ বিড়বিড় করে ওঠে, ‘বাজান, তুমি তো এখন বেহেস্তের বাগানে বয়ি রইছ। চাইয়া দেখ বাজান, তোঁয়ার নাতির দিকে চাইয়া দেখো। তুমি তারে এই মেঘের মতন ছায়া দিও। জানো, তোঁয়ার নাতি তার বাপের মতন অয় ন’। তার দাদার মতনই অইছে। হে তোঁয়ার মতন গান গায়, বাজান। তোঁয়ার মতন পাইন্যা সাইর গায়। তুমি তারে দোয়া কইর। আর আমারে..আমারে..’
কদম আলীর চোখ ক্রমে ঝাপসা হয়ে আসে। চোখের কোণ বেয়ে ঘামের ধারার মত ধারা নামে। সে তাড়াতাড়ি মুখ নিচু করে হাতের  উল্টো পিঠে চোখের কোণ মোছে। তারপর গরুদুটোর লেজ মুচড়ে দেয় সজোরে--এই হেট হেট! গরু হেট হেট...
 


শনিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১১

প্রজন্ম প্রবাসে (গল্প)


হাঁটতে হাঁটতে বাবা এক জায়গায় এসে থামলেন। উত্তরে, দক্ষিণে আর পশ্চিমে বারকয়েক তাকিয়ে মাথা নাড়লেন হ্যাঁ-সূচক ভঙ্গিতে, তারপর পুবদিকে ফিরে বিড় বিড় করে কী যেন হিসেব করতে লাগলেন। পুবে গ্রাম, চর আর কূলের মাঝখানে আগাগোড়া কোমর থেকে বুকসমান পানির আধমাইলটাক চওড়া ধারাটুকু পেরিয়ে গ্রামের সবুজ গাছপালার সারি; দিগন্তের সাথে সেঁটে আছে মনে হয়।

অনেক দূর এসে পড়েছি আমরা। কূল থেকে প্রথমে প্রায় মাইল দেড়েক হেঁটে এসে নৌকোয় মাঝখানের পানিপ্লাবিত অংশটুকু পেরিয়ে মূল চরে উঠেছি। সেখান থেকে আরো কম পক্ষে মাইল দুয়েক হেঁটেছি পশ্চিমে। প্রায়...

‘চার মাইল,’ বাবা যেন আমার চিন্তার রেশ ধরেই বলে উঠলেন।

আমি সচকিত হয়ে তাঁর দিকে তাকালাম। কিন্তু তিনি আমার দিকে তাকিয়ে নেই। তাঁর চোখ পুবের দিগন্তে সেঁটে থাকা গ্রামের দিকে। তাঁর শাদা দাড়ি অল্প অল্প বাতাসে দুলছে; বিড় বিড় করে হিসেব করতে করতে তিনি বললেন, ‘প্রায় চার মাইল হবে এখান থেকে গ্রাম, তাই না?’

আমি কাশলাম একটু। কিছু বলতে যাব ভাবছি, তিনি কিন্তু থামলেন না; বলে চললেন, ‘হ্যাঁ, চার মাইলের কম না। তাইলে সে হিসেবে, আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এখানেই আমাদের বাড়ি হবে। তুই কী বলিস?’

যেন হঠাৎ সংবিত ফিরে পেয়েছেন, এভাবেই তাঁর কথার শেষ অংশটুকু আমার দিকে প্রশ্নাকারে ছুঁড়ে দিলেন।

আমি কী বলব? কিন্তু কিছু একটা তো বলতে হবে, তাই আবার কেশে গলা সাফ করতে গেলাম। তবে তার প্রয়োজন হলো না। বাবা নিজেই তাঁর প্রশ্নের জবাব দিলেন, ‘বাড়ি না হোক, পাড়া তো হবেই।’

আমি আস্তে করে বললাম, ‘হতে পারে।’

বাবা আমার দিকে তাকালেন। তাঁর চোখে সামান্য অসহিষ্ণুতা, যেন কোনোরকম সন্দেহই তিনি আশা করছেন না। তারপর দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘হতে পারে নয়, হবেই। মুন্সির হাট থেকে, মানে যেখান পর্যন্ত নদী ভেঙেছে, তার মানে কূল থেকে এ পর্যন্ত আমরা যদি চার মাইল হেঁটে আসি, তাইলে নিঃসন্দেহে আমাদের পাড়াতে, কে জানে, হয়তো আমাদের উঠোনে কিংবা বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।’

আমি হঠাৎ একটু হাসলাম। বাবার হিসেব ভুলও  হতে পারে বলে নয়, তাঁর কল্পনা করার উৎসাহ দেখে। বাবা এখন কল্পনা করে আনন্দ পাচ্ছেন। তাঁর মুখ উদ্ভাসিত, চোখে সরল প্রত্যাশা। তাঁর মুখের  প্রতিটি রেখা এখন অদ্ভূত কোমল, পরিতৃপ্ত। অথচ বাবা যখন গম্ভ¢ীর থাকেন, কিংবা বিরক্তি বোধ করেন, তখন ওগুলোকে মনে হয় নিরেট পাথরের গায়ে এড়েবেড়ে কিন্তু সুস্পষ্ট অজস্র ফাটলের চি‎ে‎‎‎‎‎হ্নর মত। এখন বাবার উৎসাহ দেখে কে বলবে যে, জীবন সম্পর্কে তিনি ভীষণ হতাশাবাদী? শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় একটা রঙচটা প্লাস্টারখসা একতলা দালানের অধিবাসী তিনি। ওটার ভেতরের অসংখ্য দাগে দুগে ভরা ভরা চার দেয়ালের মতই শ্রীহীন তাঁর বৃত্তাবদ্ধ দৈনন্দিনতা। অবসর জীবনে পেন্সনপ্রাপ্ত ট্যুসনিনির্ভর বাবার মনে কল্পনার কোনো স্থান নেই। সুখকল্পনার তো বটেই। কিন্তু সুখের কল্পনা যে মানুষকে কেমন আলাদা সৌন্দর্য দান করে, সেটা এ-মুহূর্তে বাবাকে দেখেই আমার জানা হলো।

‘তোর সম্ভবত মনে নেই আমাদের বাড়ির লোকেশন কেমন ছিল, ঠিক না?’ বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

‘না।’ আমি মাথা নাড়লাম।

সত্যিই মনে নেই। কিংবা কিছু কিছু হয়তো আছেও। কিন্তু সেটা এতই অস্পষ্ট যে, সবটা মিলিয়েও একটা পূর্ণাঙ্গ ছবির রূপ পাওয়া যাবে না। আমার শুধু একটা বিরাট পুকুরের কথা মনে আছে, যেটায় অনেক লাল শাপলা ফুল ফুটে থাকত আর পুকুরটার পাড়ে তালগাছ না নারকেল গাছ ছিল কিছু। বাড়ির সামনে একটা শাদা ধূলিওড়া রাস্তার কথা চৈত্রের দমকা বাতাসে পাক খেয়ে ওঠা ধুলি-কুণ্ডলীর মতই হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে। একটা বাগানের  কথাও ভাবতে পারি আমি আবছা আবছা, যেটায় আমটাম কুড়াতাম হয়তো। আর স্কুল, হ্যাঁ, একটা স্কুলের কথাও আমার স্মরণে আসে, যেটা ছিল চকচকে টিনের চাল আর বাঁশের বেড়াঅলা এবং স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুর করে সবাই মিলে গান গাইতাম, ‘আমার সোনার বাংলা...’

আমি বড় হয়েছি শহরে। সব সময় দেখে আসছি ঘিঞ্জি এলাকা, গাড়িঘোড়া আর মানুষজন। সুতরাং স্মৃতির যে দু’একটা টুকরো টাকরা ছিল মনের গভীরে, সেগুলো নিয়ে ভাববার প্রয়োজন বোধ করিনি কোনোদিন। আমি তাই মাথা নাড়লাম আবার। ‘উঁহুঁ, মনে নেই আমার।’

বাবা হাসলেন মাথা দোলাতে দোলাতে, যেন আমার মনে না থাকাতেই ভালো হয়েছে। ‘দেখ,’ উবু হয়ে বসলেন তিনি। চরের নরম বালুর জমিনে তর্জনী দিয়ে দাগ কাটতে লাগলেন। উত্তরে-দক্ষিণে লম্ব^া ম্যাপের মত কিছু একটা আঁকলেন। বোঝা যাচ্ছে, এটা একটা গ্রামের পুরো ম্যাপ। ম্যাপের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় এক জায়গায় আঙুল রাখলেন। বৃত্তের মত গোলাকার দাগ দিলেন একটা। বললেন, ‘এটা, ধর, আমাদের বাড়ি। আর এটা হচ্ছে..’ বৃত্তের চারদিকে আরো কয়েকটা বৃত্ত আঁকলেন। ‘এটা হচ্ছে পাটোয়ারী বাড়ি, এটা মহাজন বাড়ি, এটা...’

একে একে বিভিন্ন বাড়ির নাম বলতে লাগলেন তিনি। আমি ম্লান হেসে বললাম, ‘এত সব বাড়ির নাম আমি শুনিনি আর।’

বাবা হাত ঝেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন আবার। ‘আমার কী মনে হয় জানিস? আমার মনে হচ্ছে, সব আবার আগের মতই হয়ে যাবে। সে পুরনো দিনের মত বাড়িঘর, গাছপালা, জমিজমা, হাট-বাজার...সব হবে। হবে না? তুই কী বলিস?’

আমি কী বলব? আগে এসব কেমন ছিল কে জানে? বাবা তো তাঁর কল্পনায় বর্তমানের ধুঁ ধুঁ চরের পটভূমিতে পুরনো দিনের সুখসমৃদ্ধ স্মৃতির প্রতিস্থাপনা খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু আমি? আমার অত স্মৃতি কোথায়? আমার স্মৃতি বলতে আমার শহর; আমার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের প্লাস্টারখসা দালানের সন্নিকটস্থ দৈনন্দিন ঘিঞ্জি এলাকা, আর আমার কল্পনা হলো, সে-ঘিঞ্জি এলাকা পেরিয়ে সুদৃশ্য সব দালানকোঠাসমৃদ্ধ পরিচ্ছন্ন  এবং সুপরিসর অঞ্চল, যেখানে স্বপ্ন আর বাস্তবের সমন্বিত অবস্থ’ান বলেই আমার বিশ^াস। আমি কোনো মন্তব্য করলাম না। কিন্তু আমি খুব অবাক হচ্ছি। বাবাকে এত উচ্ছল আর এমন হালকা মেজাজে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।

বাবা হঠাৎ পশ্চিম দিকে তর্জনী উঁচিয়ে ধরলেন। প্রায় কলকণ্ঠে চেঁচিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে উঠলেন, ‘দেখ দেখ, কতগুলো পাখি উড়ছে গোল হয়ে। ওগুলো কী রে? কবুতর, না?’

আমি ঠাহর করার চেষ্টা করতে করতে বললাম. ‘হ্যাঁ, কবুতরই তো মনে হচ্ছে।’

বাবা হেসে উঠলেন। ‘ঠিক তাই। সবগুলো গ্রাম থেকে উড়ে এসেছে। উড়ি পেকেছে তো, দানা খাবে খুঁটে খুঁটে। ওই দেখ...’ উত্তর দিকে প্রায় চরের মাটি ছুঁয়ে উড়তে থাকা আরেক ঝাঁক পাখি দেখালেন। ‘ওগুলো হচ্ছে বাবুই। বাবুই চিনিস তো?”

চেনারই তো কথা। জ্যান্ত না দেখলেও বয়নশিল্পী বাবুইর ছবি দেখেছি কত। আমি জবাব না দিয়ে বাবার দিকে চেয়ে থাকলাম। বাবাকে ভারী পরিতৃপ্ত দেখাচ্ছে। উড়ি ঘাসের দানা খুটে খাওয়ার জন্যে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে নামতে থাকা পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে পরম মমতায় বলে চললেন তিনি, ‘আসবে আসবে, বুঝলি, সব আসবে। এরপর ময়না, তোতা, শালিক, কাকÑসব আসবে। দেখবি, সব আগের মত হয়ে যাবে আবার।’

বাবার ভালোলাগা আমার মধ্যেও সংক্রমিত হতে চাচ্ছে। এ-মুহূর্তে ন্যাঙটো উদোম চরের শূন্য অবয়বে বাবার মত কল্পনার রঙ চড়াতে ভালো লাগছে আমারও। একটা পরিপূর্র্ণ ছায়াময় গ্রামের ছবি আঁকতে চাচ্ছি আমি। কিন্তু বাবার মত অমন স্বতঃস্ফূর্ততা পাচ্ছি না কেন? আমার ছবির রেখাগুলো কিছুতেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে না। উল্টেপড়া এক দোয়াত কালি যেন লেপে আছে আমার কল্পনার ক্যানভাসে।

আমাদের চারপাশে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। নতুন জেগেওঠা চরে এখনো মানুষের স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু হয়নি। মাঝে মধ্যে উড়িঘাস ছাড়া অন্য কোনো উদ্ভিদ জন্মেনি এখানে। তবু মানুষের আসা-যাওয়ার বিরাম নেই। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত তাদের বিচরণ চরের সবখানে। আমরা চর দেখছি, মানুষ দেখছি। দিগন্তের কোল ছুঁয়ে থাকা নদীর অস্পষ্ট রেখার দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের মাথার ওপরে সূর্য পুব থেকে পশ্চিমে হেলে পড়ছে। খিদে পেয়েছে আমার। আমি বাবাকে বললাম, ‘বাবা, চলেন।’

বাবা আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘জানিস, আমাদের বাড়ির দক্ষিণে একটা বড়..খুব বড় পুকুর ছিল। তখন তো গ্রামে চাপাকল ছিল না। গ্রামের মানুষ তাই সে পুকুর থেকে খাবার পানি নিয়ে যেত। সে পুকুরের পাড়ে ছিল একটা বটগাছ....’

বাবা একটু থামলেন। আমি আগ্রহসহকারে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। বাবা গ্রামের গল্প বলছেনÑএরকম স্মৃতি আমাদের কারো নেই। মার মুখে কিছু কিছু শুনেছি। কিন্তু মা কোনোদিন বাবার সামনে গ্রামের কথা বলতেন না। তাঁর হয়তো কিছুটা ক্ষোভও ছিল বাবার ওপর। একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘তোর বাবার কী যে কাণ্ড! নদী বাড়িঘর ভেঙে নিয়েছে, সে জন্যে রেগে অস্থি’র হয়ে আছে। নিজে তো গ্রামের নাম মুখে আনবেই না, কাউকে বলতে শুনলেও খেপে যাবে।’

আমি মাকে দুষ্টুমি করে বলেছি, ‘তুমিও না আনলেই পার।’

মা বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘তুইও বলছিস, না? বলবিই তো। বাপের বেটা যখন...’

আমি হাসতে হাসতে বলেছি, ‘বাপের কেন শুধু, মা? আমি তোমারও তো পুত্ররতœ বটে। কিন্তু কথা হলো, আমার বাপের ভিটে যে গ্রামে ছিল, তোমার বাপের ভিটেও ছিল সে গ্রামে। বাবা যদি তার বাপের ভিটের কথা ভুলতে পারেন, তুমি কেন তোমার বাপের ভিটের কথা ভুলতে পার না?’

মা বুঝি খুব অভিমানী, তাই মুখ ভার করে বলেছিলেন, ‘ভোলা যায়, পাষাণ হলে। তবে...’ এরপর বিষণœ স্বরে বলেছেন, ‘পাষাণও গুঁড়ো হয় রে, সময় হলে।’

আমার এখন মনে হচ্ছে, মার কথাই বুঝি ঠিক। বাবা হয়তো নদীর ওপর অভিমান করে নিজেকে পাথর করে তুলেছিলেন। তাই তিনি গ্রামের গল্প করতেন নাÑআর অসচ্ছলতা তাকে রুক্ষ এবং হতাশ করে তুলেছিল বলে আমাদের সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু যখন শুনলেন সে ভাঙা গ্রাম আবার চর হয়ে জেগে উঠেছে, তখন আর থাকতে পারেননি। আমাকে সঙ্গে নিয়েই গ্রামযাত্রা করেছেন। আসলে বাবা পাথর হয়েছিলেন, তবে নিরেট নয়, ফাঁপা। তাই প্রত্যাশার প্রথম আঘাতেই ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল তাঁর অভিমান। গ্রামে আমাদের নিকটাত্মীয় আর কেউ নেই, তবু বাবা স্বভাববিরুদ্ধভাবেই দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছেন আমাকে নিয়ে এবং এক সপ্তাহ আগেও যিনি সারাক্ষণ আমাদের সামনে গম্ভীর কিংবা বিরক্তিতে ‘ফাটব-ফাটব’ অবস্থায় থাকতেন, তিনিই এখন উন্মুক্ত চরের মাটিতে এক আকাশ রোদ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে গ্রামের গল্প শোনাচ্ছেন।

বাবা বলে চললেন, ‘বটগাছটা ছিল খুব পুরনো। তুই অবশ্য দেখিসনি।। তোর জন্মের আগেই ওটা কেটে ফেলা হয়েছিল। আমরা ছোটবেলায়..’

বাবা ছোট ছিলেন! কখন? আমি হতভম্বের মত তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি। বাবা হাসছেন, লজ্জামিশ্রিত হাসি। যেমন একটা বাচ্চা ছেলে হাসে বড়দের সামনে তার একান্ত কোনো কথা বলতে গিয়ে।

‘বটগাছটার গোড়ায় আমরা খেলাধুলা করতাম। বটের ঝুরি ধরে ঝুলতাম...’ বাবা বলে যাচ্ছেন। ‘বুঝলি, ছোটবেলায় আমি বাঁশি বাজাতাম, ভালোই পারতাম বাজাতে। বটগাছের গোড়ায় বসে বন্ধুদের নিয়ে গানটানও গাইতাম।’

আমাদের মাথার ওপর নিঃসীম নীলাকাশ, আলোকিত সূর্য; আমাদের চারপাশে মৃদু হাওয়ার অদৃশ্য উল্লাস আর আদিগন্ত শূন্যতা। এরকম শূন্যতা আমার  খারাপ লাগছে নাÑবরং শূন্যতা আমাকে শিহরিত করছে, উন্মথিত করছে। বাবার কথা, তার ছেলেবেলার গল্প সবাক চলচ্চিত্রের মত শূন্যতায় দৃশ্যায়িত হচ্ছে নানা বর্ণ-ব্যঞ্জনায়। বাবা যেন আরব্যোপন্যাসের অন্ধকার থেকে উঠে এসেছেন কোনো এক ঝলমলে শাহজাদার মত তাঁর সমস্ত গাম্ভীর্য, ব্যর্থতা আর রুক্ষতাকে অতিক্রম করে।....বাবা আমার সামনে দৌঁড়াচ্ছেন, লাফাচ্ছেন, বটের ঝুরি ধরে ঝুলছেন, দুলছেন, বাঁশি বাজাচ্ছেন আপন মনে, বড় পুকুরের টলটলে জলে হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতার কাটছেন...

কিন্তু, শূন্যতা শিহরিত করলেও আমি আর কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি?

সোনালি রোদের মত (কিশোর কবিতা)


iv‡Zi Auvavi †K‡U ax‡i ax‡i †hB nq †fvi
†mvbvwj †iv‡`i gZ †PvL †g‡j †R‡M I‡V
nvRvi wK‡kvi|
†R‡M I‡V Nvm, dzj, cÖRvcwZ, evZv‡mi †g‡q
meyR cvZviv †n‡m Avj‡Mv‡Q gv_v bv‡o wgwUwgwU †P‡q
Zvici e‡j,
AvgivI †R‡MwQ †Mv †Zvgv‡`i mv‡_, †`‡Lv
Nyg †M‡Q P‡j
Avgv‡`iI †K‡U †M‡Q †Nvi|
meyR cvZvi gy‡L gvqvex Av‡jvi gZ
GK mv‡_ †n‡m I‡V nvRvi wK‡kvi|

†n‡m I‡V †PvL †_‡K gy‡Q †d‡j †fv‡ii Kzqvkv
nvRvi wK‡kvi Pvq c„w_exi w`‡K, †kv‡b `~i n‡Z Avmv
cvnvwo Sibv Avi mxgvnxb mvM‡ii Abycg Mvb
g‡bi Mnx‡b †`vjv w`‡q I‡V ax‡i ax‡i Amx‡gi Uvb;
Avi Aweivg
evZv‡m KzRb Zz‡j Kviv †hb Wv‡K a‡i wcÖq GK bvg
Wv‡K †hb, wK‡kvi wK‡kvi
 †mvbvwj †iv‡`i gZ Avgv‡`i Kv‡Q G‡mv †mvbvi wK‡kvi|

আকাশ (কিশোর কবিতা)


AvKvk †i †Zvi m‡½ Avgvi  A‡bK K_v Av‡Q
eje †Zv‡K, ZzB hw` fvB Avwmm Avgvi Kv‡Q;
ZzB †Zv fvix `~‡i _vwKm
wbR‡K †Kgb mwi‡q ivwLm
GB c„w_exi bvMvj †_‡K
bxj Pv`‡i kixi †X‡KÑ
†Kb?
MvQMvQvwj, Nvm, cvnvo I
cvwL wKsev b`x Kv‡iv
m‡½ †bB †Zvi GKUzI fve
†hb?

Rvwbm AvKvk, Avwg †Zv‡K fvjevwm
mKvj †ejvq mywh¨Uv wVK
UzKUz‡K jvj †LvKvi gvwdK
Qovq hLb wgwó nvwm;
hLb Puv‡`i evwZ R¡‡j
Zviviv me wgwUwgwU †Pv‡Li fvlvq K_v e‡j
wKsev hLb kvšÍ w`wNi Kv‡Pi gZb UjU‡j Rj
 †Zvi †`qv bxj Qvqvi Pv`i Mvq Rwo‡q
wS‡gvq †Kej
ZLb AevK †P‡q _vwK
Avbg‡b iOaby AuvwK
fvjevmvi Zzwj w`‡q
mvZiK‡gi iO eywj‡q
ivwk ivwk
Rvwbm AvKvk, †Zv‡K wK †h fvjevwm?

Av”Qv AvKvk, `~‡i †_‡K ZzBI eywS Lye `ytL cvm
bB‡j †Kb Kv‡jv †Pv‡L Agb K‡i AkÖ“ Sivm?
mevB e‡j, e„wó IUv
Avwg fvwe, nvq KZUv
AkÖ“ n‡j e„wó S‡i eySZ hw` gvby‡liv
ZvivI Z‡e AvKvk n‡Zv, mvMi n‡Zv, b`x n‡Zv
Sibv n‡Zv cv_i‡Niv|




চড় (গল্প)

বেলা প্রায় দুটো। কাপ্তাই জেটিঘাটের আজমীর বেকারিতে এখন লোকজন বিশেষ নেই। এ-সময়টায় একটু কম থাকারই কথা। নৌকোর নাইয়াগুলো সকালের চা-নাস্তার পর বেলা বারোটা পর্যন্ত বসে বসে আড্ডা মেরেছে; হাসি-ঠাট্টা, হৈ-হুল্লোড় আর খিস্তি খেউড়ে নরক গুলজার করেছে। এখন দুপুরের ভাতটাত খেয়ে নৌকোয় বসে তাস পিটাচ্ছে নয়তো ভোঁসভোঁসিয়ে ঘুম দিচ্ছে।
জেটিঘাটের লেবাররা আড্ডা মারার সময় পায় না। কাপ্তাই লেকে এখন ভরা পানি। কাজের ফুল সীজন। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত গাড়ি লেগে থাকে। ফায়ারউডে, বাঁশে, শনে নয়তো গোলগাছে। হরদম চলছে লোড-আনলোড। দেরি টেরি করলে ড্রাইভাররা প্যাঁ পোঁ জুড়ে দেয়, মাঝিরা এসে দাঁত খিঁচোতে শুরু করে। তারাও তাই কেক-পেটিস-হালুয়া-বাটারবন-নোনতা নয়তো বেলা বিস্কুট দু’হাতে খেয়ে বসতে না-পারার ক্ষতিটা খেয়েই পুষিয়ে নেয়।
মোস্তাকের খুব বাজে একটা অভ্যাস আছে। দিনের বেলা ঘুমোতে পারে না। শুয়েছিল কিছুক্ষণ। ঘুমোতে পারেনি। গরমে ভাঁপা পিঠের মত থকথকে হয়ে শেষমেষ খুব কিছুক্ষণ গালাগালের চোটে গরমের চৌদ্দ গোষ্ঠি উজাড় করে তাড়া খাওয়া মোষের মত নৌকো ছেড়ে হন হন করে বেকারিতে এসে ঢোকে। ডান দিকের টেবিলগুলোর একটায় খালি চেয়ার পেয়ে ধপ করে বসে পড়ে। দু’পা তুলে দেয় চেয়ারের ওপর। নবাবি মেজাজে হুকুম চালায়, ‘এই, এক কাপ চা দে রে...’ 
ক্যাশিয়ার বসে ঢুলছিল। হাঁক শুনে লাল চোখদুটো মেলে চাইল। হাতের কাছে রাখা কলিং বেলের সুইচটা টিপে দিল সজোরে। টু-ইন-ওয়ানে ভারতীয় বাংলা গান বাজছে। ক্যাসেটটা পাল্টে হাসান-হোসেনের জারির ক্যাসেট চাপিয়ে দিল এবার।
গরম চায়ের কাপটা সামনে আসতেই মোস্তাক সোজা হয়ে বসে। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে ভোঁ ভোঁ করে। গরম টরম সব পালিয়েছে। এখন চায়ের বাদামী রং আর দুধ-চিনি-পাতা মেশানো ওভালটিনের তাজা গন্ধটা তাকে চাঙা করে তোলে। পিরিচে না ঢেলে কাপসুদ্ধ ঠোঁটে ছুঁইয়ে লম্বা চুমুক দেয় সে। তারপর শাহী কায়দায় হাঁক ছাড়ল ক্যাশিয়ারের উদ্দেশে, ‘তাহের মিয়া, হিন্দি লাগাও।’
 কোণের দিককার টেবিলে টুপি মাথায় খোঁচা খোঁচা চাপ দাড়িঅলা একটা লোক বসেছিল। মোস্তাকের কথা শুনে হাঁ হাঁ করে উঠল। ডান হাতটা উত্তরে-দক্ষিণে নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘না না, জারিটাই চলুক। হযরত ইমাম হাসান-হোসেনের (র.) জারি। আহা হা হা...’ টুপিসুদ্ধ মাথাটা বারকয়েক নাড়ল সে ডানে বাঁয়ে। ‘...ওরে গুণের ভাই... কে তোরে খাবাইল জহর...’
কদমছাট চুল আর কানের ওপর তুলে কাটা জুলফিঅলা লোকটা খোঁচা-দাড়ির একেবারে বিপরীত দিকের কোণটাতে বসেছিল। গরমের দাপটে আর ওভালটিনের গন্ধঅলা চায়ের মৌতাতে এতক্ষণ নজরে পড়েনি মোস্তাকের। তাছাড়া ওর দিকে পিঠ দিয়ে বসেছিল সে। হঠাৎ বুলেটের মত ছুটে এল যেন অর্ডারটা, ‘আগের সে বাংলা ক্যাসেটটা লাগাও তো, ক্যাশিয়ার।’
অর্ডারটা বেসুরোভাবেই কানের ফুটো গলে ভেতরের নরম পর্দাটায় তীক্ষè একটা ধাক্কা দিল। মোস্তাকও তাই বুলেটপ্র“ফ গলায় বলল, ‘বাসতে বাসতে পর্বত পর্বত... মোহাম্মদ রফির সে গানটা, তাহের মিয়া...’
কদমছাট খেপে গেল। গর্জে উঠল, ‘আমি বলছি বাংলা গান!’
‘আমি বলছি হিন্দি গান। আর আমিই আগে বলেছি।’
তাহের মিয়া চোখ টিপল। ডোরাকাটা পোশাক আর কানের ওপর জুলফি তোলা কদমছাট চুল দেখলে বাচ্চা ছেলেটাও চোখ বুজে বলে দিতে পারে, ইনি...
তাহের মিয়ার চোখ টিপুনি দেখে লোকটার আত্মমর্যাদা চাড়া দিয়ে উঠল এবার। ‘বাঙালি হয়ে বাংলা গান শুনতে চাও না! দেখি কী করে হিন্দি লাগাও!’
মোস্তাক খ্যা খ্যা করে ওঠে, ‘আরে রাখেন মিয়া! অত স্পীচ দিয়েন না। অমন বাহাদুর হোন তো দেশের সবগুলো হিন্দি গানের ক্যাসেট বাজার থেকে তুলে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন দেখি।’
লোকটার গর্জন বন্ধ হয়ে গেল আচমকা খেই হারিয়ে। কথার আগুন মুখ দিয়ে বেরোবার পথ না পেয়ে চোখে গিয়ে জমা হলো। মৃদু হাসল মোস্তাক। ক্ষমতা আর অসহিষ্ণুতার রং আরো অনেক দেখেছে সে।
‘আচ্ছা, তোমায় দেখব।’ লোকটা লাফ দিয়ে উঠল চেয়ার হতে। হাতের ঠেলায় টেবিলটাকে ধাক্কা মেরে কিছুটা সামনে সরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে। টেবিলের ওপর চায়ের খালি কাপটা পিরিচের মধ্যে ঝনাৎ করে ওঠে। আধাভর্তি পানির গ্লাসদুটো টাল সামলাতে না পেরে প্রথমে টেবিলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তারপর গড়াতে গড়াতে ঝনঝনাৎ করে নিচে, একেবারে পাকা মেঝের ওপর। লোকটা তাতে ভ্রƒক্ষেপ মাত্র না করে ক্যাশের সামনে এসে চায়ের দামটা ফেলে দিয়ে আগুনে চোখে মোস্তাককে দেখে নেয় একবার। তারপর হন হন করে বেরিয়ে যায়।
 মোস্তাক বিড়ি ধরায়। লম্বা একটা টান দিয়ে ভোঁস করে এক দলা ধোঁয়া ছেড়ে দেয়। ফ্যানের বাতাসে ঘুরপাক খেতে থাকে ধোঁয়ার দলাটা।
ক্যাশিয়ার খেপে যায়। ‘শালা বানচোতগুলা!’ গালাগাল শুরু করে সে। ‘কতদিন না বলেছি কাস্টমার চা খাওয়ার সাথে সাথে খালি কাপ-পিরিচ আর গেলাস টেবিল থেকে তুলে নেবার জন্যে! দিল তো এখন দু’দুটো গেলাস ভেঙে? রাখ শালাইন, তোদের নামেই তুলব গেলাস ভাঙার জরিমানা।’
বয়গুলো এমনিতেই হাঁ হয়ে গিয়েছিল। ক্যাশিয়ারের গালাগাল শুনে কী করবে ঠাহর করতে না পেরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। একজন এসে তাড়াতাড়ি ভাঙা কাচের টুকরোগুলো কুড়োতে লেগে গেল।
ক্যাশিয়ার এবার মোস্তাকের দিকে চাইল। ‘কাজটা ভাল করলি না, মোস্তাক।’ হাসান-হোসেনের জারির ক্যাসেটটা খুলে নিয়ে হিন্দি গানের ক্যাসেটটা লাগিয়ে দেয় সে। ‘এদের না ঘাটানোই ভাল। ক্ষমতা যখন এদের হাতে, তখন বেঁধে নিয়ে কষে ঠেঙাতেও বাধবে না।’
 মোস্তাক অবজ্ঞার হাসি হাসে। ‘পাতি বাঘ! ডোরাকাটা হলে কী হবে?’
 বেরিয়ে আসে সে। মেজাজটা তেতো হয়ে গেছে। মিথ্যে বলেনি ক্যাশিয়ার।  মেজাজ ঠিক রাখতে পারেনি সে। কদমছাট চুল আর খাটো জুলফির লোকটা খারাপ কিছু বলেনি। বাঙালির বাংলা গানই শোনা উচিত। লোকটা আদতে সে কথাই বলতে চেয়েছে। তবে সমস্যা হলো গিয়ে ওর গলায় ক্ষমতার দাপট দেখা গেছে বলেই মোস্তাকের ভাল লাগেনি। তাই তার চোখা জবাব দিয়েছে সেও। কিন্তু লোকটা সেটা বুঝলেই তো। নাহ, হপ্তাখানেক দেখে শুনে চলতে হবে।
বদল হক সওদাগরের দোকানের দিকে তাকিয়ে দেখে সে। কাঁচা মিষ্টি কুমড়ার মত গোল হয়ে বসে আছে সওদাগর সাহেব। কর্মচারী ছেলেটা ডাল মাপছে কাগজের ঠোঙায়। দু’একজন খদ্দের আছে। নাহ, আড্ডা মারার চান্স নেই। কুমড়োপেটা বোতলমুখো সওদাগরটাকে একদম নাপছন্দ মোস্তাকের। ব্যাটা যেন কোরান-হাদিছ আর মছলা-মছায়েলের জাহাজ। হাতের কাছে মওকামত কাউকে পেলেই চোখ বুজে বিতরণ করতে লেগে যায়। অসহ্য লাগে তখন, আঞ্চলিকতাকে যখন জাতীয় পর্যায়ে ফেলে সোসিওলজির জ্ঞানদান করতে শুরু করে। বক্তৃতার সারমর্ম: চিটাগাইঙ্গা ইজ দ্য বেস্ট অব অল ইন বাংলাদেশ।
সামনের দিকে হাঁটা শুরু করল সে। মদীনা হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল। বাংলা ছবির গান বাজছে ফুল ভল্যুমে। ‘প্রাণ সজনী’র গান। ঢুকে পড়ল সে। অ্যান্ড্রু কিশোরের গাওয়া গানটা খুব ভাল লাগে। ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে..’ সুরের জাল আর কথার মালায় কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ‘লারে লাপ্পা’র কড়া থাপ্পড়ের জ্বালা থেকে নি®কৃতি পাওয়া যায়।
খালি মুখে গান শোনা জমে না। পকেটের স্বাস্থ্যও আজ লাকড়ি বেচা পয়সার বদৌলতে মোটামুটি তেলতেলে। সুতরাং বয়টা কাছে এসে দাঁড়াতে এক প্লেট গরম পেঁয়াজুর অর্ডার দেয় মোস্তাক।
 পেঁয়াজু চিবুতে চিবুতে কিছুক্ষণ আগে আজমীর বেকারিতে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা  মনে মনে ঝালাতে শুরু করে। আজকের দিনটাই শালার মাটি! সকাল থেকে শুরু হয়ে গেছে ঝগড়াঝাটি। মেট মাঝির সাথে লাকড়িবেচা পয়সা নিয়ে হয়ে গেছে এক চোট। নৌকোর গলুই-পাছা পুরো করে  কড়–ই আর ভুরা গাছের লাকড়ি এনেছিল তারা খেপ নিয়ে আসার সময়। এক নজর দেখলেই বলে দেয়া যায় কম করে হলেও শ’তিনেক টাকার লাকড়ি তো হবেই। ধড়িবাজ শালাটা কোন ফাঁকে মির্জির সাথে যোগসাজস করে এসে বলে কিনা মাত্র দুশ’ টাকা বেচা গেছে লাকড়ি। মির্জি হারামখোরটাও তাই সাক্ষ্য দিচ্ছে। দেবেই তো। চোরে চোরে খালাতো ভাই যখন!
তা বেশ। দুশ’ টাকাই না হয় হলো। তবু তো মেট মাঝির দু’ভাগ বাদ দিয়ে নাইয়া তিনজনের ভাগে তেত্রিশ টাকা করে পড়ে। তিন টাকাও বাদ যাক। তিরিশ টাকা। আর শালা কিনা দিতে চাচ্ছে মাত্র বিশ টাকা করে। হলো এক চোট।
কী যে করবে শালা অত টাকা দিয়ে! লাকড়িবেচা পয়সা, বাজার খরচা থেকে মারা পয়সা, নাইয়ার বেতন থেকে ছুতো নাতায় কেটে রাখা পয়সাÑমাসে না হলেও পাঁচ-ছয় হাজার করে বানাচ্ছে। কিন্তু করছেটা কী? কই, নিজে তো এতদিনেও পারল না একটা নৌকোর মালিক হতে। মদ, জুয়া আর ‘ভাই’এর পেছনেই তো দিচ্ছে সব। ভাই! এই ‘ভাই’এর জাতটাকে একদম দেখতে পারে না মোস্তাক। রং আর চেহারা দেখে মায়া টায়া লাগলেও পাছা দেখে লাত্থি মারতে ইচ্ছে করে। শালা বেজম্মারা! মোটা একটা গাল ঝেড়ে দেয় ও থুতুর দলার মত।
মিলিটারিটা কী করতে পারে? ওপারেই তো ক্যাম্প। ক্যাম্পে গিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা টরোয়ানা নিয়ে আসবে নাকি?
‘মোস্তাক ভাই।’
 পেছনে ফিরে দেখে ও। হারু মাঝির ভাই। মায়ের পেটের নয়, মুখবোলা। হাতে ঘড়ি। গায়ের টেট্রনের শার্টটা চিনতে পারে সে। হারু মাঝির। একটু বড় হলেও মানিয়েছে বেশ। মাসদুয়েক আগে বানিয়েছিল ওটা হারু মাঝি ড্রেস পার্ক থেকে। মোস্তাকসহ পছন্দ করেছিল পিসটা। ঘড়িটাও নিশ্চয় তার। শালাটার আক্কেল আর হলো না।  কত ঘড়ি, শার্ট আর দামী দামী লুঙ্গি নিয়ে যে পালাল এই ভাইয়ের গোষ্ঠিগুলো! আক্কেল হবে কী? বউ-ছেলেমেয়ে থাকলেই তো! থাকবে কী করে? তিরিশ পেরিয়েছে কবে, শালা আজতক বিয়েই করেনি। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা এই ভাই নিয়েই তো আছে।
‘কী?’ মোস্তাক কড়া চোখে চায়।
‘না, এমনি।’ কাছে এসে বসে ছেলেটা। ‘চা খাওয়াও না এক কাপ।’ মিঠে হাসির ঢল ওর সারা মুখে।
মোস্তাকের ইচ্ছে হয় কষে দুটো চড় লাগায় ছেলেটার দু’গালে। কিন্তু থেমে যায়। কী লাভ? বরং হারু মাঝির সাথে শত্র“তা শুরু হবে শুধু শুধু। আর ছেলেটারই বা দোষ কী? সে তো আর মার পেট থেকে শিখে আসেনি এসব। মারতে হয় তো...
 ছেলেটার চেহারা সত্যিই মায়াবী। মায়াই হয় মোস্তাকের। র্নিষ্পাপ দুই চোখে অদ্ভুত সারল্য। এক কাপ চা আর চারটা পেঁয়াজুর অর্ডার দিয়ে দেয় সে।
খুশি খুশি মুখে মোস্তাকের দিকে তাকায় ছেলেটা। ভাবতেই পারেনি তার জন্যে সত্যি সত্যিই চা আর পেঁয়াজুর অর্ডার দেবে মোস্তাক। মোস্তাককে নিয়ে তার অনেক কৌতূহল আছে। ভাব জমাতে চেয়েছে আরো আগে। কিন্তু পাত্তা পায়নি।
 সে কাপ্তাই এসেছে মাত্র মাস কয়েক। এরই মধ্যে অনেক রকম মানুষ দেখেছে। গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে চাওয়া মানুষের অভাব নেই এখানে। যখন তখন মিষ্টি খাওয়াতে চায়, সিনেমায় নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম এই লোকটা। সবার চেয়ে কেমন যেন আলাদা। হারু মাঝির কাছে শুনেছে, মোস্তাক ভাই ম্যাট্রিক না কী যেন পাস। সে ভেবে বুঝে উঠতে পারে না, এতদূর লেখাপড়া করলে লোকটা নৌকোয় চাকরি করে কেন? কিন্তু মোস্তাককেও জিজ্ঞেস করার সাহস হয়ে ওঠেনি তার। কেমন যেন রাগী রাগী লোকটা।
 পেঁয়াজু চিবুতে চিবুতে বাইরে তাকায় ছেলেটা। বাঁশের গাড়ি উঠছে নামার চর থেকে ফার্স্ট গিয়ারে গোঁ গোঁ করতে করতে। শুক্কুর চেয়ারম্যানের দোকানের সামনে ভীড় করে দাঁড়িয়েছে কয়েকজন। লালমুখো চারজন বিদেশিকে দেখা গেল ভীড় ঠেলে বেরিয়ে আসছে।
বিদেশি দেখলে তার খুব মজা লাগে। পেঁয়াজু খেতে খেতে মোস্তাকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেদিকে। খুশি খুশি মুখে বলে, ‘ইস, কী সাদা! টুরিচ, না?’
 মোস্তাক হাসিমুখে মাথা নাড়ে।
বিদেশি চারজন হোটেলে এসে ঢোকে। দু’জন মেম। মেম দু’জন ক্যাশের সামনে দাঁড়ায়। সায়েব দু’জন পেছনে।
‘এনি কোল্ড?’ সুরেলা গলায় একজন মেম প্রশ্ন করে।
‘কোকাকোলা অর ফান্টা অর সেভেন আপ?’ অন্যজন সুর মেলায়।
কোকাকোলার নাম শুনে ক্যাশিয়ারের হা করা ঠোঁটদুটো জোড়া লাগে।
‘অ্যাঁ..হ্যাঁ.. হ্যাঁ..জী..জী!’ রীতিমত ব্যস্ত হয়ে পড়ে ক্যাশিয়ার।
‘হ্যাভন্ট?’
‘ইয়েস। দেয়ার’স আ রেফ্রিজারেটর ইন দ্য কর্নার।’ ক্যাশিয়ারের দিকে চেয়ে হাসে একজন সায়েব। ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলে, ‘ফ্রিজ ঠেকে চারটা কোক ডিন তো।’
‘ওহ, থ্যাঙ্কস!’ মেম দু’জন সায়েবদের দিকে চায়। চারজনে ফ্রিজের কাছাকাছি টেবিলটা দখল করে। পরস্পর মুখোমুখি বসে খুশিতে ছলকে ওঠে।
ক্যাশিয়ারের হাঁকাহাঁকি, বেল টেপাটেপি; বয়-বেয়ারাদের ছোটাছুটি। নতুন ন্যাপকিন নিয়ে এসে টেবিল মোছা, গ্লাস মেজে পরিষ্কার করা, ফ্রিজ খোলাÑহুলুস্থুল ব্যাপার।
ততক্ষণে  ফের ঘের দেয়া হয়ে গেছে চারদিকে। জোড়ায় জোড়ায় উৎসুক চোখ মেমদুটোকে কাঠঠোকরার মত ঠুকরে খাচ্ছে। মেম দু’জন উসখুস করে।
‘ওহ, হাউ ননসেন্স দ্য গেদারিং!’ একজনের পাতলা লাল ঠোঁটদুটো থেকে বিরক্তি ঝরে পড়ে এক রাশ।
‘এই যে, আপনারা একটু ভীড়টা পাটলা করেন। প্লি-জ!’ বাংলা জানা সায়েবটার গলায় অনুনয়।
‘অ..হ্যাঁ হ্যাঁ..ইয়েচ ছার। উই..উই..অ্যাই, তোমরা সব সরে দাঁড়াও। সরে দাঁড়াও!’ জেটির কেরানী সাব কৃতার্থ হয়ে যান। তিনিও আছেন ভীড়ে। কথাটা বলার সময় তার দিকেও একবার চেয়েছে সায়েব। সুতরাং বিশিষ্ট ভদ্রলোক হিসেবে ভীড় সরানোর দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নেন তিনি।। দু’একজনকে সরিয়ে দিতে যান। ধাক্কা টাক্কাও মারেন। তারপর সায়েবদের কাছে এসে আলাপ জমাতে চান। ‘ছার, ইউ..মানে..ইউ ট্রাভেলার?’
‘খেন? ফর হোয়াই?’ গায়েপড়া ভাব পছন্দ হয় না সায়েবের। সরাসরি বিরক্তি প্রকাশ করে। ‘আপনার টাটে খী প্রয়োজন? আর য়ু আ গাইড? স্যরি, উই ডোন্ট নিড এনি গাইড।’
‘জী.. হোয়াট? মানে হোয়াট ইউ চে ছার?’ কেরানি সাব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান।
‘আমি বলসি, সরে যান। ভীড় করবেন না। উই আর নট দ্য বীস্টস অভ জু। উই আর হিউমেন জাস্ট লাইক য়ু।’
ভীড় পাতলা হতে শুরু করে। কেরানী সাব হতাশ হয়ে আরেকটা চেয়ারে বসে চায়ের অর্ডার দেন। মেমগুলো কাচভাঙা হাসি হাসে। দেশি ভাষায় একচোট বকে নেয় একটা মেম।
মোস্তাক মৃদু হাসে। শালারা! লাল চামড়া দেখলে যেন সবার মাথা খারাপ হয়ে যায়। কী শিক্ষিত, কী চাষা। হাজার হলেও এক সময়ের প্রভুদের জাত তো! পুরাতন ভৃত্যদের কাছে ইজ্জত তো পাবেই।
হারু মাঝির ভাইটা খুব হাসছে লোকগুলোর সুড় সুড় করে পালানো দেখে। হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে গড়িয়ে পড়তে যায়। মোস্তাকও হাসে। ছেলেটা মোটামুটি মিশুক বটে।
‘কী রে মোস্তাইক্যা, পাইয়জ্জে না উ¹া?’ বলতে বলতে একজন ঢোকে। ‘ঠিগাছে, চালা। তয় আঁরার মিক্কাঅ এককানা চাইছ টাইছ...’
ফিশারীর লেবার, গালফুলা জামাইল্যা। ফোলা গালের ওপর কুঁতকুঁতে চোখদুটোতে সারাক্ষণ শয়তানি হাসি খেলছে।
‘কী হদ্দে?’ মোস্তাকের মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে যায়। স্থির চোখে তাকায় লোকটার দিকে। লোকটার পিঙ্গল দু’ চোখে বিকৃত রহস্যের থিকথিকে কাদা। মণিদুটো চকচক করছে সাপের পিঠের মত। লোকটা কাপ্তাই জেটিঘাটের আরেক নোংরা হোমো।
 মোস্তাক ঘেমে ওঠে। বোশেখ মাসের গুমোট, হিন্দি-বাংলার ঝগড়া, মেট মাঝির শয়তানি, বদল হক সওদাগরের উন্নাসিকতা, সায়েবটার ধমক আর মেমদুটোর মন্তব্য ধীরে ধীরে ওর মগজে যেন  কেমন এক ধরনের উত্তাপ জমাতে শুরু করেছিল।
‘কী হইয়ুম আর? আঁরার হতাঅ মনত টনত রাখিছ।’ চোখ টিপে হারু মাঝির ভাইয়ের দিকে চেয়ে রসালো ইঙ্গিত করে লোকটা। দুই কানের গোড়া পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয় ফোলা গালের ওপর দিয়ে ময়লা দেঁতো হাসিটাকে। মোস্তাক উঠে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে লোকটার সামনে এগিয়ে যায়। ভাল করে চেয়ে দেখে। তারপর হঠাৎ দাড়টানা কড়াপড়া হাতে ঠাস করে প্রচণ্ড এক চড় বসিয়ে দিল গালফোলা, কুঁতকুঁতেচোখা লোকটার ডান গালে।