জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

বুধবার, ২১ মার্চ, ২০১২

সেপ্টেম্বরে যশোর রোডে :মূল : অ্যালেন গিন্সবার্গ অনুবাদ : মাসুদ আনোয়ার





লাখ লাখ শিশু শুয়ে আছে চুপচাপ
আকাশের দিকে বড় বড় চোখ মেলে
টিঙটিঙে পেটে ক্ষুধার তীব্র তাপ
সাত সাগরের ঢেউয়ের মতো খেলে
যশোর রোডের সারি সারি চালাঘর
ধুঁকছে, ধূসর যন্ত্রণায় কাতর।

লাখ লাখ বাবা-মার কান্নায়
লাখ লাখ ভাই গেল যুদ্ধে
বোনদের লুকানোর স্থান নাই
শত শত হায়েনার মধ্যে।

ক্ষুধায় মলিন দাদার মুখের হাসি
দাদীদের মুখে নেই রূপকথা আর
চাচা পায়নি তো একমুঠো ভাত বাসি
বড় অভিমানে চাচীর মুখও ভার।
এলো চুলে ঘোরে কিশোরী কন্যা মাঠে
একটু শাপলা অথবা শালুক পেলে
পেটের ভেতরে শূন্যতা কিছু কাটে
শত শত শিশু ভেসে যায় বেনো জলে।

উনিশ শো একাত্তরে
যশোর সড়ক ধরে
লাখ লাখ লোক চলে কলকাতা চলে
পেছনে নিহত স্বজন-বন্ধু ফেলে
নিজ ভূমি ছেড়ে চলে কলকাতা চলে।

কেমন মিছিল কাদা-মাটি ভরা পথে
গরুর গাড়িতে চাপিয়েছে সংসার
দু’পাশের বিলে হাওয়ায় দুলছে পানি
অশ্রু-ধোঁয়ায় যেন কালো রঙ তার।
কঙ্কালসার বালক বলে না কথা
মৃত্যুর ভয়ে কলজে শুকিয়ে কাঠ
বোবা চোখে তার একটি চাওয়াই শুধু
এক মুঠো ভাত, একটি খেলার মাঠ।

মার চোখে অশ্রুর বন্যা
ক্ষুধার্ত পুত্র ও কন্যা
বাবা বসে দুই হাত কপালে
বুকে চেপে কষ্টের ঝরনা
কেঁদে ওঠে, ‘ভগবান! আল্লা!
ঘরবাড়ি ভিটে ছাড়া করলা!’

ছোট দুটি শিশু চোখ মেলে চেয়ে আছে
বিদেশি দেখেই আশার ঝিলিক তাতে
তারা জেনে গেছে বিদেশি মানেই খাবার
চকোলেট নয় বিস্কুট দেবে হাতে।
ঘরে ভাত নেই, বাবা চলে গেছে ভোরে
ক্যাম্প অফিসে যদি বা রেশন মেলে
তিন-চারদিন ধরে উপবাসী পেটে
হাজার হাজার উপবাসী ভীড় ঠেলে।
যুদ্ধপীড়িত বাংলাদেশে এখন
খেতে কাজ নেই, মাঠে লোক নেই, কোনো
ঘরে ভাত নেই, শিকেয় ঝুলছে হাঁড়ি....
জ্বলছে না উনোনও।

যশোর রোডে মায়ের কান্না, শিশুর আহাজারি
বাবা গেছে রেশন আনতে শূন্য ভাতের হাড়ি
সেলুলয়েডের ফিতায় কচি শিশুর ক্ষুধিত মুখের
অভিশাপে ভরা ছবি---
বিপন্ন এই মানবতা আহা কীভাবে ভুলতে পারি!

হুইসেল মুখে বাঁশের দণ্ড হাতে
পাহারাদারের রক্তচক্ষু, তবু
ক্ষুধিত শিশুর হল্লা, বাড়ানো হাতের
আঙুল কাঁপছে, জীবন-মরণ প্রভু
অন্ধ-বধির-বোবা, সে জানে না কিছু।
বিকারবিহীন হাঁটে জালিমের পিছু।
ক্ষুধার মিছিলে শৃঙ্খলা লাঠি নামে
শিশুরা হাঁফায় ক্ষুধায়, কষ্টে ঘামে।

কেন এই শিশুরা এইখানে কেন, এখানে তাদের কাজ কী
নতুন কোনো মজার ঠিকানা এখানে পেয়েছে আজ কি
চেঁচামেচি হাসি-হল্লা তাদের এখানে কেন যে চলছে
এ ঘরে রয়েছে অনেক খাবার কে এটা তাদের বলছে?
হঠাৎ কে যেন ধমকে উঠল, ‘সরে যা সরে যা, আর নেই
রিনরিনে কচি গলায় সহসা বেজে ওঠে হাহাকার, ‘নেই!’

বিশীর্ণ হাতে নিয়ে শূন্য থালা
ক্ষুধার্ত শিশু ঘরে ফেরে
বাবা-মার বুক ফাটে দীর্ঘশ্বাসে
বিড় বিড় করে মাথা নেড়ে
বলে, ‘আহা, ভগবান! আল্লা মাবুদ
পেটে কেনে জোটে না রে এক মুঠো খুদ।’

মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে পুষ্টিহীনতা, পেটের পীড়ায়
ভুগছে মানুষ, ধুঁকছে শিশুরা টিঙটিঙে পেট প্লীহায় ভরা
মায়ের শীর্ণ স্তনের বোঁটায় অপুষ্ট মুখ শিশুর চোষণ
দুধ আসে না তো, অবুঝ ক্রোধে মায়ের কোলে হাত-পা ছোঁড়া
রিফ্যুজি ক্যাম্পের হাসপাতালে নবজাতকের শীর্ণ পাঁজর
রোগ-শোক-তাপ,মৃত্যু মিছিল, জন্মের স্রোত তবু নিরন্তর।

আমেরিকা তুমি পৃথিবী জুড়ে শান্তি বাঁচাতে লড়াই করো
ভিয়েতনামে শান্তি আনতে লক্ষ নাপাম বোমা ছোঁড়ো
এখানে এই যশোর রোডে সারি সারি বাঁশচালার ঘরে
মৃত্যু মেতেছে কালো উৎসবে, ধুঁকে ধুঁকে বাঁচা মানুষ মরে
পেছনে তাদের বুটের শব্দ, ঝাঁক ঝাঁক গুলি; বিজাতীয় হাসি
হাসছে হায়েনা, কিছুই মানে না, বাতাসে ওড়ে ধোঁয়ার রাশি।
আমেরিকা তুমি সভ্য হয়েছ, ভব্য হয়েছ মানুষ হওনি
কেবল শিখেছ অ্যাটম ছুঁড়তে, মানুষ বাঁচাতে সবক লওনি।

যশোর রোডে লক্ষ শিশুর শোকের মাতম
পশুর চোখেও ঝরায় অশ্রু, মানুষ অনড়
গম্ভীরতার মুখোশ পরে ফন্দি আঁটে
গায়ে পরে কূটনীতির কালো চাদর।

প্রশ্ন উড়ছে আকাশে বাতাসে, প্রশ্ন ভাসছে জলে
ভারত মহাসাগরের সীমানা পেরিয়ে আটলান্টিকে
প্রশ্ন খুঁড়ছে মাথা ইউরোপে, প্রশ্ন অস্ট্রেলিয়ায়
প্রশ্ন ঝুলছে নাকের ওপর, প্রশ্ন আমেরিকাকে
কেন এ অশ্রু, কেন সন্তাপ, কেন এ বর্বরতা
কেন এ মৃত্যু, কেন নীরবতা, কিসের সার্থকতা
কে দেবে জবাব? জবাব ঘুমায় ঘোর পুঁজিবাদী পকেটে
মানুষ যেখানে সংখ্যামাত্র; সভ্যতা ওড়ে রকেটে।

লক্ষ লক্ষ গাড়ি চলে আমেরিকায়,
নানারকম স্বাদু খানা যায় ভেসে যায়
নিউ ইয়র্কের পানশালাতে কত যে মা
জলের মতো মদ গেলে। না, জল গেলে না
সিগারেটের ধোঁয়ায় ওড়ে রাতের নেশা
গাড়ির নরম সীটে পরম সুখান্বেষা।

বন্ধ করো এই যুদ্ধ, থামাও উন্মত্ততা
নিজের বুকের গভীরে বারেক দৃষ্টি হানো
মানুষের চোখে, অনুভব করো যা সত্য, তা
একটি বারের জন্যে নিজেকে মানুষ মানো।
আর কত শিশুর মৃত্যু হলে মায়েরা খুঁজবে
আর কত শিশুর মত্যু হলে বাবারা বুঝবে
তাদের ট্যাক্সে তৈরি হচ্ছে মারণ অস্ত্র
তাদের মূঢ়তা শিশুদের করে বিপদগ্রস্থ।

কার কাছে চাইবে যে শিশু তার খাদ্য
কে তাকে কোলে নেবে? আছে কার সাধ্য?
কার বুকে ঘুমোবে সে বাবা-মা তো বেঁচে নেই
এসো তবে সভ্যতা, এক পাক নেচে নেই!

যশোর রোডের দু’পাশে বাঁশের ঘর
লক্ষ মানুষ বাঁচতে নিয়েছে ঠাঁই
বাঁশের চাটাই ভরেছে বমি ও ঘামে
একমুঠো চাল মাটির হাড়িতে নাই।

ভাই গেছে যুদ্ধে বোন বসে অসহায়
দাদা-দাদী, চাচা-ফুপু চলে গেছে কে কোথায়।
আর কত প্রাণ যাবে হায়েনার হামলায়
আর কত দোষী হবো বিবেকের মামলায়
আর কত মানুষেরা খালি পেটে থাকবে
বোধ অনুভূতিহীন ঈশ্বরে ডাকবে?

২টি মন্তব্য:

  1. অসাধারণ একটি কবিতা । ধন্যবাদ আনোয়ার ভাই এই কবিতাটি অনুবাদ করার জন্য ।

    উত্তরমুছুন
  2. আপনাকেও ধন্যবাদ, ভাই। কবিতাটা পড়ার জন্যে।

    উত্তরমুছুন