জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

সোমবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১১

উপনিবেশ টুপনিবেশের গপ্পো (কিশোর গল্প)

‘বুঝলি, ব্যাটা পিচ্চি পিঁপড়া অত্তো বড় হাতিটার পায়ে কুট্টুস করে লাগাল এক কামড়। বেচারা হাতি খাচ্ছিল কলাগাছ, কামড় খেয়ে চমকে উঠে দিল এক হাঁকÑমা..ও..ও..ত, অর্থাৎ কিনা মাগো...তারপর লেজ উঁচিয়ে, কান বাজিয়ে, শুঁড় ঘোরাতে ঘোরাতে শুরু করল তুর্কি নাচ। না, তুর্কি তো নয়, ভরতনাট্যম। নাচ দেখতে তিনলাখ মানুষ নেমে এল আকাশ থেকে। সবগুলোই ইংরেজ।’

‘মামা, ইংরেজ! ভুল হচ্ছে না তো? আমার তো মনে হয়, ওরা আসলে ফরাসি,’ গাবুভাই প্রতিবাদ করল।

‘তোর এরকম মনে হওয়ার কারণ কী?’ মামা ধমকে জিজ্ঞেস করল গাবুভাইকে।

গাবুভাই ভড়কে গেল মামার মারমুখী প্রশ্নে। মিন মিন করে বলল, ‘মামা, শুনেছি ইংরেজরা নাকি কাঠখোট্টা। নাচ টাচ খুব একটা বোঝে না। তবে ফরাসি জাতটা রসিক। শিল্পমনা। নাচ-গান ওসব বোঝা ওদেরই কম্ম।’

‘তুই ঠিক শুনেছিস।’ মামা হেসে অভয় দিল গাবুভাইকে। ‘আসলে ওরা ফরাসি হবারই কথা ছিল। কিন্তু জানিস তো, জাতে জাত টানে, কাঁকড়ায় গাঁত টানে। ফরাসিদের তাই দুর্ভাগ্য, মার্কিনিরা তাদের সবগুলো রকেটই নাকি ধার দিয়েছে ইংরেজদের। আফটার অল, বেশিরভাগ মার্কিনির পূর্বপুরুষদের জ্ঞাতিভাইদের বংশধর তো! আমেরিকা আর ইংল্যান্ড তো চাচাতো জেঠাতো ভাই। বুঝলি না?’

‘জী মামা,’ গাবুভাই আহ্লাদে মাথা নাড়ল মামার সমর্থন পেয়ে। কিন্তু বিলু গেল খেপে। মামাকে ভজিয়ে ভুজিয়ে সে-ই বসিয়েছিল গল্প শোনার জন্যে। এখন মামার গল্পের বহর দেখে তেলে বেগুন ছাড়ল। ‘থামাও তো প্যাঁচাল!’

কিন্তু প্রীতি, যে কিনা মাত্তর পাঁচ বছরেরটি, চোখ টোখ আণ্ডা বানিয়ে কোঁৎ কোঁৎ করে গিলছিল মামার গল্প, বিলুর রাগ দেখে কপালে ভাঁজ ফেলল বুড়োদের মত করে। ‘আহ, থামো না আপু!’ তারপর মামাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা মামা, এট্টুসখানি পিঁপড়া অত্তো বড় হাতিটাকে কামড়ে দিল কীভাবে?’

‘এট্টুসখানি পিঁপড়া,’ মামা প্রীতিকে কোলে টেনে নিয়ে টুক করে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘অত্তো বড় মানুষটাকে কামড়ে দেয় যেভাবে!’

‘তা-ই!’ প্রীতি অবাক। তারপর গাল ফোলাল, ‘জান মামা, কাল না আমাকে অত্ত বড় একটা পিঁপড়া কামড়ে দিয়েছিল।’

‘পিঁপড়াটা ভাল নয়,’ মামা গম্ভীর মুখে রায় দিল।

‘থামবি প্রীতি?’ বিলু মহা বিরক্ত।

‘কী?’ প্রীতি মামার কোলে যুত হয়ে বসতে বসতে বলল। ‘কামড়ায়নি? তুমিই তো বকলে আমাকে খালি পায়ে উঠোনে নেমেছি বলে।’

‘ডাব্বু মামা, গল্প বলবে?’ বিলু মামাকে বলল।

ডাব্বু মামা গোমড়া মুখে বলল, ‘তুই শুনলেই তো।’

‘শুনছি না তো কী?’ বিলু ঝাঁজিয়ে উঠল। ‘তাই বলে তুমি বানিয়ে বানিয়ে আবোল তাবোল বকবে?’

‘আবোল তাবোল কী বকলাম?’

‘নয় তো কী? পিঁপড়ার কামড়ে হাতির খবর হয়? আচ্ছা, তা না হয় হলো। তাই বলে হাতিটা একদম লাফিয়ে উঠে নাচতে শুরু করবে? আচ্ছা না হয় নাচলও, তাই বলে সে নাচ একেবারে ভরতনাট্যম? মামা, মাথা ঠিক আছে তো?’

‘বিলকুল।’ ডাব্বু মামা নিজের মাথার তালুতে একবার তবলা বাজিয়ে নিল। ‘ওটা বাংলাদেশী হাতি নয়, ভারতীয়। আসামের দার্জিলিংয়ের। তাতেই ভরতনাট্যম শিখেছে। নয়তো মনিপুরী শিখত। ক্লিয়ার?’

‘কচু!’ বিলু ঠোঁট ওল্টাল। ‘তা হাতির নাচ দেখতে আকাশ থেকে গুনে গুনে তিনলাখ মানুষ নামল? তোমার কথা শুনে আকাশে মানুষ ঘর-বাড়ি বানিয়ে বাস করে, এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? তা না হয় করলাম, তাই বলে আকাশ থেকে নেমে আসা মানুষগুলোর সবগুলোই ইংরেজ? কেন, অন্য কোনো জাত হতে পারল না?’

‘না, পারল না।’ ডাব্বু মামা মাথা নাড়ল। ‘এসব কাজে ইংরেজ ছাড়া অন্য জাত তেমন দড় নয়। উপনিবেশ টুপনিবেশের ব্যাপার তো ইংরেজদের একচেটিয়া প্রায়। নইলে কি আর আমেরিকা সাধেই ওদের তিনলাখ রকেট ধার দেয়?’

‘আচ্ছা, সে না হয় হলো। এখন.. কী যেন বললে? উপনিবেশ? সেটা আবার কী?’

‘কিসসু জান না!’ মামা খেঁকিয়ে উঠল। ‘পড় তো সায়েন্স। শিখেছ তো কেবল এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার ইকুয়েল টু এ স্কোয়ার মাইনাস বি স্কোয়ার।’

গাবুভাই ভয়ে ভয়ে হাসল একটু। ‘মামা, ইয়ে, এ প্লাস...’

‘যেটা জান না,’ বিলু রুখে উঠল। ‘সেটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না তো। এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার ইকুয়েল টু এ স্কোয়ার মাইনাস বি স্কোয়ার নয়। স্কুলজীবনে অঙ্কে তো নাকি পেতে লাড্ডু। আম্মু এখনো বলে।’

প্রীতি মামার মুখ দু’হাতে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে, ‘মামা, আমি জানি। শোনো, এ প্লাস বি সি ডি ই এফ জি...’

বিলু বিরক্ত মুখে বলে, ‘প্রীতি, তুই যাবি এখান থেকে? ফাজিল মেয়ে! সব তাতেই বিদ্যে জাহির!’

‘আমি গল্প শুনব!’ প্রীতি মুখ ঝামটা মারল।

‘হ্যাঁ মামা,’ গাবুভাই উৎসাহ পেয়ে বলে। ‘এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার ইকুয়েল টু এ স্কোয়ার প্লাস টোয়াইস এবি প্লাস বি স্কোয়ার। অ্যালজেব্রার প্রথম সূত্র।’

মামা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘তাই! কিন্তু আমি তো সূত্র বলিনি, অনুসিদ্ধান্ত বলেছি।’

‘থাক, তোমাকে আর কষ্ট করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে না। তুমি দয়া করে উপনিবেশ কী, সেটা বলো।’

‘বুঝলি বিলু,’ মামা বিজ্ঞের মত হাসল। হালে পানি ফিরে পেয়েছে। ‘ইতিহাস না-জানলে এমনি হয়। আরে বাবা, বিজ্ঞান পড়িস ভাল কথা। তাই বলে একটু আধটু ইতিহাস চর্চা করবি না? জাতির ইতিহাস না-জানলে নিজের জাতীয়তা নিয়েও তো শেষে হাবুডুবু খাবি।’

প্রীতি শুনছিল। ‘হাঁস’ হাবুডুবু খাচ্ছে শুনে তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ জানাল, ‘না ডাব্বু মামা, হাঁস তো ডোবে না। সাঁতরাতে পারে। মুরগী ডুবে যায়।’

‘ঠিক বলেছিস,’ মামা সমর্থন জানাল প্রীতিকে। ‘বুঝলি বিলু, তোরা হলি মুরগী। হাবুডুবু খাওয়া ছাড়া তোদের আর গতি নেই।’

বিলু খেপে গিয়ে ফেটে পড়তে যাচ্ছিল। কী মনে করে আবার মত পাল্টাল। পরম ধৈর্যবতীর মত বলল, ‘মামা, হাঁস-মুরগীর গল্প না-হয় পরে শুনব। এখন দয়া করে উপনিবেশ জিনিসটা কী, ব্যাখ্যা করে বলো।’

‘ব্যাখ্যা করে? ঠিকাছে, শোন। আলোচ্য অংশটুকু কবি..কবি..এই যা, কবির নাম তো ভুলে গেছি রে!’

বিলু বলল, ‘মামা, তুমি বড় যন্ত্রণা করছ। ঠিকাছে, আমি বলে দিচ্ছি কবির নাম। আলোচ্যাংশটুকু কবি মোহাম্মদ ডাব্বু মিয়ার ‘আজগুবি’ নামক প্যাঁচাল থেকে নেয়া হয়েছে...’

‘কারেক্ট,’ আঙুলে তুড়ি দিয়ে বিলুকে উৎসাহ দিল ডাব্বু মামা। বাকিটা নিজেই শুরু করল, ‘এখানে বলা হয়েছে যে, উপনিবেশ মানে হচ্ছে...ইয়ে, টুপনিবেশের বিপরীত শব্দ...অর্থাৎ...’

আবার মুখিয়ে উঠতে যাচ্ছিল বিলু, কিন্তু তার আগে প্রীতি আঁতকে উঠল। ‘ডাব্বু মামা, কারেন্টে হাত দিয়ো না... মরে যাবে!’

বিলু ধমকাল। ‘তুই থামবি, প্রীতি? ডেঁপো মেয়ে কোথাকার? বলছে কারেক্ট, শুনছে কারেন্ট!’

‘থ্যাঙ্কু,’ ডাব্বু মামা আরেকটা চুমু খেল প্রীতিকে। ‘উঁহুঁ, কারেন্টে হাত দেব না।’

 গাবুভাই মুখ কালো করে বলল, ‘অবজেকশন, ডাব্বু মামা। থ্যাঙ্কুটা বাংলায় দিলে হতো না? আফটার অল আমরা বাঙালি..ইয়ে বাংলাদেশী...’

‘আফটার অল আমরা বাঙালি! ইয়ে বাংলাদেশী!’ মামা কিছু বলার আগে বিলু ভেংচি কাটল। ‘তুমি যে একটা বাংলাদেশী ছাগল..ছাগল নয়, রামছাগল, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। দাড়ি নেড়ে ভ্যাঁ করে জানান দিতে হবে না আর।’

গাবুভাই ভীষণ আহত হয়ে বলল, ‘মানে? ইনসাল্ট করছিস? আমরা বাংলা বলব না? বায়ান্ন সালে রক্ত দিয়েছি কিসের জন্যে?’

‘ওটা তোমার রক্ত নয়। সালাম-রফিক-জব্বার নামের কয়েকটা ছেলের।’

গাবুভাই নাছোড়। ‘বুঝিয়ে বল, বিল্লি।’

বিলু বলল, ‘গাট্টা খাবে আরেকবার বিল্লি বললে। মামাকে ‘থ্যাঙ্কু’র বদলে বাংলায় ‘ধন্যবাদ’ বলার পরামর্শ দিতে গিয়ে নিজে কটা ইংরেজি শব্দ বলেছ, খেয়াল করেছ? অবজেকশন, আফটার অল, ইনসাল্ট...’

গাবুভাই মাথায় হাত বুলাতে লাগল, যেন বিলু সত্যি সত্যিই গাট্টা মেরে দিয়েছে। মুখকে প্যাঁচা বানিয়ে বলল, ‘স্যরি।’

বিলু ধমক দিল, ‘আবার!’

মামা সোৎসাহে সমর্থন জানাল বিলুকে, ‘রাইট, বিলু। ইয়ে..মানে ঠিক। আমাদের প্রতিনিয়তই বাংলা চর্চা করা উচিত।’

বিলু বিরস মুখে বলল, ‘ভাল। কিন্তু এখন উপনিবেশটা কী, বলবে নাকি চলে যাব? দেখো, টুপনিবেশের বিপরীত শব্দ, এটা যেন আবার বোলো না।’

প্রীতি গম্ভীর মুখে বলল, ‘মামা, ঝগড়া করা কি ভাল?’

‘কক্খনো না।’ মামা প্রীতিকে আরেকট চুমু উপহার দিতে গেল খুশি হয়ে। প্রীতি মামার মুখ দু’হাতে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ধুৎ মামা! তোমার মুখে সিগারেটের গন্ধ।’

মামার মুখ কাচুমাচু। বিলু হাততালি দিয়ে বলল, ‘দারুণ, প্রীতি! আবার বল! আয় তুই আপুর কাছে। আমি তোকে চুমু খাব।’

প্রীতি বলল, ‘না।’

‘কেন? আমি তো সিগারেট খাই না।’

‘না বাবা, দরকার নেই। তুমি খালি বকো। চুমু দিতে গিয়ে যদি কামড়ে দাও। তোমার যা রাগ! কই মামা, এট্টুসখানি পিঁপড়া অত্তো বড় হাতিটাকে কামড়ে দিল, কামড় খেয়ে ব্যথা পেয়ে বেচারা হাতি নাচতে শুরু করল, আর নাচ দেখতে তিনলাখ টুপনিবেশ নেমে এল আকাশ থেকে। মামা, টুপনিবেশ কী?’

মামা হঠাৎ খুশি হয়ে বলল, ‘ফাইন, মানে খুব ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছ, প্রীতি। আসলে উপনিবেশ নয়, শব্দটা হচ্ছে টুপনিবেশ। আর গাবু, তোর ধারণা ভুল, তবে মিথ্যে নয়। আসলে আকাশ থেকে তিনলাখ ইংরেজ নয়, টিংরেজ নেমে এসেছিল নাচ দেখতে।’

গাবুুভাই দু’চোখ গাব গাব করে তাকাল ডাব্বু মামার দিকে। ‘টিংরেজ! সেটা আবার কোন জাত?’

ডাব্বু মামা ব্যাখ্যা করল, ‘নতুন কিছু নয়। তবে ইংরেজদের নব সংস্করণ বলতে পারিস। কিন্তু বিলুকে বোঝাবার জন্যে আগে উপনিবেশ কী, সেটা বলতে হবে। শোন বিলু, সে-যুগে ফরাসি, দিনেমার, স্প্যানিশ, ওলন্দাজ, পর্তুগীজ আর ইংরেজরা পেটের দায়ে নিজ নিজ দেশ ছেড়েছিল ভিন দেশের উদ্দেশে। কেউ তলোয়ার হাতে, কেউ বুকে বাইবেল বেঁধে, কেউ বা ঝোলা কাঁধে ব্যাপারী সেজে ভিনদেশের লোকদের কাছে হাজির হলো। তারপর তো বুঝিস, মন্দলোকের যা কাজ, এমনি ভাবে, তেমনি করে, অন্য দেশের ভালমানুষদের মাথায় বাড়ি মেরে নিজেদের কপাল ফিরিয়ে নিল। সেসব দেশের রাজা বনে গেল, সেসব দেশের জায়গা-জমি দখল করে নিজেদের জন্যে বাড়িঘর বানাল।

‘এক সময় এমন হলো যে, ওদের জ্বালায় সেসব দেশের আসল অধিবাসীদের টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়ল। এটাকেই বলে উপনিবেশ। আর এদের সবার মধ্যে চালাকি আর শঠতার দিক দিয়ে ইংরেজরা ছিল বেস্ট, মানে সর্বোত্তম, মানে ধুৎ...দেখ তো বিলু, কী যন্ত্রণা! দু’একটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না-করলে দেখছি কথাই বলা যাচ্ছে না। ‘সর্বোত্তম’এর সোজা বাংলাটা কী রে?’

বিলু হাসল। ‘সর্বোত্তম-এর সোজা বাংলা হলো সবার বাড়া। অভ্যাস করতে করতে ঠিকই ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা চলে আসবে।’

‘তা ঠিক,’ মামা সায় দিল। ‘তো এখন উপনিবেশ কী, তা তো বুঝলি, না?’

‘বুঝলাম,’ গাবুভাই বলল। ‘কিন্তু উপনিবেশ কী করে ‘টুপনিবেশ’ হয় আর ইংরেজরা ‘টিংরেজ’ হলো কবে থেকে, সেটা বলো।’

মামা বলল, ‘সেটাই ইন্টারেস্টিং--ওই দেখ, আবার এসে গেল ইংরেজি শব্দ। ইন্টারেস্টিং--এর সোজা বাংলা কী রে বিলু?’

বিলু অবলীলায় বলল, ‘কেন, মজার!’

‘ফাইনÑমানে দারুণ!’ মামা বিলুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো। ‘তোর মাথা আছে রে বিলু! সত্যিই বলছি।’

বিলু প্রশংসায় গলল না। উল্টো ঝাঁজিয়ে উঠল। ‘তোমাদেরগুলোও কোনো চুলোয় যায়নি। হাত দিয়ে দেখো, ঘাড়ের ওপর ঠিকই বসানো আছে।’

মামা হতাশ ভঙ্গিতে মাথায় হাত বুলাল। মামার দেখাদেখি প্রীতিও। ‘হ্যাঁ, মামা। আমারটাও আছে।’

মামা খেদের সাথে বলল, ‘বিলি, তোকে বোঝা আমার কম্ম নয় রে। মানুষ তো জানতাম, প্রশংসা পেলে খুশি হয়। তুই যে দেখি মারতে আসিস!’

বিলু হেসে ফেলল। ‘তাহলে সেটা নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই।’

মামা অবাক হয়ে বলল, ‘নেই মানে?’

বিলু মহা বিরক্ত হলো। ‘কী আশ্চর্য! নেই মানে নেই। তোমাদের ইংরেজিতে যাকে বলো হ্যাভ নট!’

এবার মামা বিরক্ত হ্েরলা। ‘দেখ বিলি, নেই মানে না-বোঝার মত অতটা গর্দভ আমায় ভাবিস নাতো। আমি বলতে চাচ্ছি, প্রশংসা পেলে তুই খুশি হবি না কেন? ’

বিলু বলল, ‘খুশি হবার কী আছে? বরং ভয় পাবারই কথা।’

গাবুভাই ভয়ে ভয়ে বলল, ‘কেন? ভ-ভয় কেন?’

বিলু বলল, ‘দেখো গাবুভাই, তোমার মত গবেট হলে ভয়ের কিছু নেই। কারণ তোমাদের কপালে প্রশংসা জোটে ক্বচিত। তাই তোমাদের কাছে প্রশংসা মহা মূল্যবান জিনিস। কিন্তু আমি প্রতিবার ক্লাসে প্রথম হবার সুবাদে কম প্রশংসা শুনিনি এই পর্যন্ত। আবার আমি এটাও জানি যে,  প্রশংসার বিপরীত শব্দটার নাম নিন্দা। একবার যদি প্রথম থেকে দ্বিতীয় হয়ে যাই কোনো কারণে, তাহলে নিন্দা ছুটে আসবে বিষ পিঁপড়ার মত। অথচ সাধারণ মানের ছাত্রী হলে প্রথম হওয়ার আনন্দ যেমন পেতাম না, তেমনি তা হারানোর বেদনাও থাকত না। সুতরাং আমি মনে করি, প্রশংসা পেয়ে আনন্দিত হওয়ার চেয়ে ওটাকে ধরে রাখার জন্যে ভয়ে ভয়ে থাকাই উচিত। তাছাড়া একটা লোক বুদ্ধিমান বলেই বুদ্ধিমান, তাকে এত ফোলানোর দরকার নেই। আর যে বোকা, সে বোকা বলেই বোকা, এতেও নিন্দা করার কী আছে?’

গাবুভাই হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল, ‘পেয়েছি, এবার তোকে বাগে পেয়েছি, বিল্লি। আচ্ছা বল তো, তুই যে ‘ক্লাস’ শব্দটা বললি, এটা তোর কোন বাংলা অভিধানে আছে? ওটা তো জলজ্যান্ত ইংরেজি শব্দ। বিল্লি, অপরের ভুল ধরা খুব সোজা, না রে?’

আচমকা বিলু লাফিয়ে উঠে ঠক ঠক দুটো গাট্টা বসিয়ে দিল গাবুভাইয়ের মাথায়। ‘বলেছিলাম না বিল্লি ডাকলে গাট্টা খাবে, গাবুভাই?’

গাবুভাই বোকার মত হাসল। ‘এই যা! সত্যি সত্যিই গাট্টা মেরে দিলি, বিল..’

গাবুভাইকে গাট্টা খেতে দেখে প্রীতি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল মামার কোল থেকে।

মামা মুরব্বীর ঢঙে বলল, ‘উঁহুঁ, নো ঝগড়াঝাটি...মানে, ঝগড়াঝাটি একদম কাম্য নয়। যাক বিলু, উপনিবেশ কাকে বলে তা তো বুঝলি। এবার টুপনিবেশ...’

বিলু গাবুভাইকে বলল, ‘কই, ‘লি’ বাদ দিলে কেন? বলো।’

গাবুভাই মাথায় হাত বুলাল। ‘স্যরি।’

বিলু মামার দিকে চেয়ে হাসল। ‘থাক মামা, আর কষ্ট করতে হবে না। টুপনিবেশ কী, তা আমি বুঝেছি, আর ‘টিংরেজ’ মানেও জেনেছি। বলব?’

‘হ্যাঁ-এ!’ মামা উৎসাহ দিলেন। ‘বল।’

বিলু বলল, ‘আগে শোনো ‘টিংরেজ’ কী? ‘টিংরেজ’ হলে তোমরা, যারা বাংলায় কথা বলতে গিয়ে ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে দাও ফাঁকে ফাঁকে। ইংরেজি বাজনা শুনতে শুনতে পিঁপড়ার কামড় খেয়ে চমকে ওঠা হাতির মত বল ড্যান্স শুরু কর। ’

মামা আঁতকে ওঠার ভান করল। ‘বলিস কী রে?’

বিলু হাসল। ‘ভুল বলেছি? আর টুপনিবেশ হলো টিংরেজদের বসবাসের স্থান, যেখানে তারা থাকে শেকড়ছেড়া কচুগাছের মত। পরিষ্কার? আর গাবুভাই, গাট্টা মারার জন্যে দুঃখিত। ভাল কথা, ক্লাস কিন্তু বাংলা শব্দ, যেমন তোমার গায়ে শার্ট। মোট কথা, বাংলা ভাষা যদি কোনো বিদেশি ভাষার শব্দকে নিজে থেকে খেতে চায়, তাহলে খেতে দিয়ো। কিন্তু জোর করে গিলিয়ে দিয়ো না। তাতে বদহজম হবে।’

প্রীতি বলল, ‘কই মামা, এট্টুসখানি পিঁপড়া...’

বিলু প্রীতিকে বলল, ‘না রে প্রীতি, মিছে কথা। এট্টুসখানি পিঁপড়ার কামড়ে অত বড় হাতির খবরই হয় না!’









































কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন